Satkahon – Richa Sarkar | সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী ঋচা সরকার

Satkahon – Richa Sarkar
ফোনের ওপারে উত্তর আমেরিকার আটলান্টা শহর এপারে কলকাতা। সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী ঋচা সরকার তাঁর জীবন গল্পের ঝুলি থেকে একরাশ অভিজ্ঞতা উজার করে দিলেন সাতকাহন কে।
সাথে সুদূর আটলান্টা থেকে ভিডিও করে পাঠালেন তাঁর ঘরের সবচেয়ে প্রিয় জায়গাটির, যেখানে বসে কখনো রবীন্দ্রনাথ কখনো নজরুল আবৃত্তি করেন আপন মনে, আবার কখনো বা বৃষ্টি ভরা দিনে নীল আকাশের মেঘবালিকা হয়ে যেতে চান তিনি…
আসুন জেনে নিই কেমন তাঁর এক হৃদয় বাংলা সংস্কৃতি আঁকড়ে প্রবাস যাপন…!

বই আমার সই
ছোট্ট ঋচা যখন তাঁর মায়ের কোলে, ঠিক তখনই এক মাত্র ছেলেকে হারান তাঁর দিদা। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি, ডাক্তার পরামর্শ দেন ছোট্ট মেয়েটিকে যদি তাঁর কাছে কিছুদিন দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন তিনি। তাই হয়, এক মা কে ভালোবেসে আর এক মা সমর্পণ করেন তাঁর সন্তান। ডাক্তার এর কথা ফলেও যায়, সুস্থ হয়ে ওঠেন দিদা। প্রায় ৬ বছর পর ঋচা ফিরে আসেন বাবা মার কাছে।
কানপুরের জন্ম হলেও তাই বেলঘরিয়ায় মামারবাড়িতে বেড়ে ওঠা তাঁর। বাবা-মা বাংলার ছাত্র ছাত্রী ছিলেন তাই কবিতার প্রতি প্রথম ভালোবাসা তৈরি তাঁদের হাত ধরেই। প্রথমত বেলঘরিয়ায়,এবং পরে সল্টলেকে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রায়শই অনুষ্ঠিত হত পাড়ায়, তাই অনুষ্ঠানে পরিবেশনের জন্য ছোটবেলাতেই অনেক কবিতা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন তিনি। এই সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে তৈরি হতেন রীতিমত বই পড়ে, সেই ক্ষেত্রেও বরাবর বাবা মা ও পরিবারের সাহায্য পেয়েছেন তিনি।

আবৃত্তি রুপায়ন
এরপর, শ্যামবাজার বানীচক্রে ভর্তি হন তিনি। সেখানে কবিতার পাশাপাশি গান নাচ ইত্যাদি নানারকম চারুকলাই শেখানো হত, তাই তখন থেকেই সামগ্রিক ভাবে শিল্পীসত্ত্বা তৈরি হয়ে উঠেছিল তাঁর মনে।
শ্রী প্রদীপ ঘোষের ছাত্রী রমা বসুর কাছে প্রথম প্রথাগত আবৃত্তি শিক্ষার শুরু। বাগবাজার মালটিপারপাস স্কুল এ পড়াশুনা করেছেন তিনি। পাড়ার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিদ্যালয়ের নানা অনুষ্ঠানে ছোট থেকেই অংশ নিতেন। এমনকি সেই ছোট বয়স থেকেই বিভিন্ন কবিতা অনুষ্ঠান পরিচালনাও করেছেন। সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন কবিতা কে নাটক করে আবৃত্তি রুপায়ন অনুষ্ঠান করতেন তিনি।
এরপর কলেজ জীবনের স্মৃতিতে তিনি বলেন,
“আমি বিধাননগর গভর্নমেন্ট কলেজে পড়তাম। দেখলাম বাংলা মাধ্যমের তুলনায় ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যাই অধিক। সেখানেই বন্ধু তাপস রায়ের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন কবিতার অনুষ্ঠানে ওর সাথে মহিলাকণ্ঠটি আমি আবৃত্তি করতাম। যেমন পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’ কবিতায় আমি পাঠ করেছিলাম তাপসের সাথে। শুধু তাই নয় তিন বছর কলেজে যত অনুষ্ঠান হয়েছে প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেছি আমি। তাই সেই সময় থেকেই উপস্থাপনার প্রতি আমার ভীষণ রকম একটা আগ্রহ জন্মায়।
কি ম্যাগাজিন পড়া হয়?
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন এবং ছোটোখাটো চাকরিও করছেন তখন, তার মধ্যেই বিবিধ ভারতির নানারকম বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন কৌশিক ভদ্র,দেবল দেব বর্মা প্রমুখের সাথে, আকস্মিক জন্ডিস ধরা পড়ল। সেই সময় বাড়িতেই থাকতে হতো। তাই রেডিও শুনতেন ভীষণভাবে। হঠাৎই একদিন রেডিওতে লোক নেওয়ার একটি বিজ্ঞাপন শুনে আবেদন করে বসলেন। শুধু উত্তীর্ণই নয়, প্রথম স্থান অধিকার করে আকাশবাণীতে অনুষ্ঠান সংযোজক এবং উপস্থাপক হিসেবে যোগদান করলেন ঋচা। তাঁর কথায়,
“আকাশবানীতে প্রথম স্থান পাওয়া আমার জীবনের অন্যতম পাওয়া, কারণ রেডিও আমাকে বাচিক শিল্পের এক জগত খুলে দিয়েছিল।একটি মজার অভিজ্ঞতা বলি, ১৯৯৭ সাল, প্রথম টক শো করতে চলেছি এক বিশিষ্ট উপস্থাপকের সাথে। তিনি প্রশ্ন করলেন কি কি ম্যাগাজিন পড়া হয়? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম আনন্দমেলা আর খেলা। তিনি বললেন, এইসব পড়লে টক-শো হবে না, দেশ পড়তে হবে। দু’ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠানের জন্য তিনি আমাকে স্ক্রিপ্ট লিখে আনতে বললেন। যদিও আমি কোনদিনই স্ক্রিপ্ট লিখে অনুষ্ঠান করতে ভালোবাসি না তবে তখন যেহেতু আমি নবীন শিল্পী, সেটা করতেই হল। পরের দিকে অবশ্য আর তা করতে হয়নি।আকাশবাণী থেকেই আমি বিভিন্ন স্বনামধন্য মানুষের সান্নিধ্যে আসি। উর্মিমালা দি,জগন্নাথ দা সৌমিত্র বসু,সতীনাথ দা, দেবাশীষ বসু, দেবরাজ রায় বহু মানুষের স্নেহ পেয়েছি, কাজ করেছি।
সেই সময় সকালে হত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ভোরাই, দুপুরে আলাপন ও রাতে হত আজ রাতে বলে একটি আলোচনাধর্মী অনুষ্ঠান। ২৫শে বৈশাখ, নববর্ষ থেকে শুরু করে সমস্ত রকম অনুষ্ঠানে ডাক আসত আমার। আকাশবাণীতে যে কয়েক বছর আমি ছিলাম সেই সময় আমি সমগ্র বাংলা জুড়ে যা অনুষ্ঠান করেছি সেই সময় খুব কম শিল্পীরাই হয়ত তা করেছেন।”
বিবাহ বিভ্রাট
বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রসদন, জোড়াসাঁকো, বিধান নগর মেলা, বিভিন্ন যুব উৎসব সব জায়গায় উপস্থাপিকা হিসেবে তখন একচেটিয়া অনুষ্ঠান করছেন তিনি, কিন্তু এমন সময় পরলেন প্রেমে। বিবাহসূত্রে পাড়ি দিতে হল সুদূর আমেরিকা। তাই মাত্র তিন বছরই আকাশবাণীতে কাজ করার সুযোগ হয়েছে তাঁর।
শিল্পসত্ত্বার আগুন নিভে যায় না কখনোই, আমেরিকাতে অংশগ্রহন করলেন বঙ্গ সম্মেলন, বঙ্গমেলা, রবীন্দ্রমেলা একাধিক অনুষ্ঠানে।

আটলান্টা আবৃত্তি চর্চা
একক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি উত্তর আমেরিকার আটলান্টা শহরে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘আটলান্টা আবৃত্তিচর্চা’। প্রবাসী বাঙ্গালী হিসেবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মানুষ এই সংস্থার সাথে যুক্ত।
বিদেশ যাবার পর প্রথম ১১ বছর দেশে বিদেশে বিভিন্ন একক অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। পরবর্তী ১০ বছর ধরে বাংলার আবৃত্তিশিল্পকে বিদেশে নানা ভাবে প্রচার ও প্রসার করে চলেছেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে দিয়ে। তাঁর উদ্যোগেই আটলান্টা আবৃত্তিচর্চা আয়োজিত ‘কবিতা উৎসব‘ পালিত হয় উত্তর আমেরিকায় প্রথমবার। ৪০ জনের বেশি আবৃত্তিকার অংশগ্রহণ করেন এই অনুষ্ঠানে। উপস্থিত ছিলেন শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কবি রুদ্রশংকর।

আমি থেকে আমরা হতে চেয়েছি চিরকাল
কি পাইনি তার হিসাব মেলাতে চাইনা আমি কখনোই, তবু বলব, ইচ্ছে ছিল থিয়েটর এ অভিনয় করার, কিন্তু রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম তাই সেই অনুমতি পাই নি, নাম নেব না তবে কিছু ব্যাক্তিত্বহীন সরকারি আমলাদের কটু আবেদন শুনেছি সেই সময়, একজন ২৩-২৪ বছরের যুবতিকে ষাটোর্ধ ব্যাক্তির ঘুরতে যাবার অনুরোধ বা রসিকতা যাই হোক এখন ভীষণ হাস্যকর তবে সেই সময় খুব অপমানজনক লেগেছিল।
আবার প্রথম দিকে বিদেশে এসে যখন মঞ্চে কোন আবৃত্তি করছি, তখন মঞ্চ থেকে নামার পর অনেকেই প্রশ্ন করলেন শাড়ির দাম কত, মাথার নকল ফুলটা কোথা থেকে কিনেছি কিন্তু কবিতা কেমন লাগল কেউ বললেন না। ভিতরে ভিতরে খুব গুটিয়ে যাচ্ছিলাম। তবে সামলে নিয়েছি বা বলতে পারি সামলে দিয়েছে একঝাঁক নতুন ছেলে মেয়ে, যাদের নিয়ে আটলান্টা আবৃত্তি চর্চায় আমি নতুন করে কবিতা নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম।
ভালো লাগাও আছে। মনে পড়ে সংবাদ প্রতিদিনে আমার প্রথম সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। তখন জগন্নাথদা আমাকে চিনতেন না, শুধু সাক্ষাৎকার পড়ে ফোন নাম্বার খুঁজে তিনি আমাকে ফোন করেন ও শুভেচ্ছা জানান।
কাজ করতে চেয়েছি অনেক, কিছু হয়েছে, কিছু হয়নি, আসলে উদ্দেশ্য সকলের সমান নয়, মানুষের আত্মকেন্দ্রিক ব্যবহারের কাছে কখনো কখনো আমি হেরে গেছি। আমাদের ‘আমি’ গুলো অনেক সময় আমাদের থেকেও বড় হয়ে দাঁড়ায়, এগোতে দেয় না। তাই আমি থেকে আমরা হতে চাইলেও মাঝপথে বাধা সৃষ্টি করে। তবুও আমি চিরকাল আমরা হতে চেয়েছি, পরবর্তীকালে সাথে পেয়েওছি অনেক মানুষকে। ভালো মন্দ মিশিয়েই তো জীবন।
পাশের মানুষটাকে একটু স্বীকৃতি দিন
“ইচ্ছে করলেই শিল্পী হওয়া যায় না, তার জন্য চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ,সঠিক কান এবং অভ্যাস।বাচিক শিল্পে আভিজাত্যের একটা জায়গা রয়েছে, সেই জায়গাটা ধরে রাখতে হবে। তার জন্যে স্বনামধন্য গুণী মানুষদের আবৃত্তি শুনতে হবে। তবে এখন আমরা এমন একটা দিকে চলে যাচ্ছি যেখানে অন্যের প্রশংসা করার স্বভাবটা আসতে আসতে হারিয়ে যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া ভীষণ ভাবে সক্রিয়, সেখানে স্বল্প জনপ্রিয় অনেকে খুব ভালো কাজ করলেও কেউ বলেন না বাহ ভালো লাগল তবে অধিক জনপ্রিয় কোন মানুষের কোন নতুন কাজ যদি আপেক্ষিক ভাবে ভালো নাও হয় সেখানে প্রশংসার শেষ থাকে না।
আসলে শুধুমাত্র আবৃত্তি নয় সব শিল্পক্ষেত্রের উদ্দেশ্যেই একটি কথা বলব, সেটি হলো পাশের মানুষটাকে একটু স্বীকৃতি দিতে হবে। সে যেই হোক না কেন তার চেষ্টায় একটু উৎসাহ দিয়ে বলতে হবে তোমার কাজটা ভালো হচ্ছে, অবশ্যই সম্পর্ক বুঝে সেই কাজের ভালো-খারাপ দিকটা বুঝিয়ে দিতে হবে। অনুপ্রেরণাও অনেক সময় মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় উন্নততর লক্ষ্যের দিকে।”
প্রবাসে দীর্ঘ বছর রয়েছেন তিনি, তবুও স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ, বা এক বাঙালীর সাথে আর এক বাঙালী হয়ে কথা বলার সময় অন্য ভাষার যৎসামান্য ব্যাবহার বুঝিয়ে দেয়,তিনি বাংলা সংস্কৃতির একজন সত্যিকারের অনুরাগী। গর্ব করে বলা যায় প্রবাসী বাঙ্গালী তথা বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী ঋচা সরকার বাংলা সংস্কৃতির মধুকর। কারণ, শুধু মাত্র শিল্প চর্চা বা সংগঠন তৈরিই নয়,অনেক গুণী শিল্পীকেও তিনি নিয়ে এসেছেন তাঁর অনুষ্ঠানে। একদিকে যেমন ভারতবর্ষ থেকে শোভন সুন্দর বসু, শ্রীজাত, সুবোধ সরকার, অলোক রায় চৌধুরী বিভিন্ন গুণী শিল্পী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন অন্যদিকে নবীন শিল্পী, নবীন প্রতিভাকেও সুযোগ দিয়েছেন নিজের সাধ্যমত।
আগামী দিনে তাঁর হাত ধরে বাংলা ও বাঙালীর শিল্প চর্চা ছড়িয়ে পড়ুক দেশ থেকে দেশান্তরে, রইল শুভ কামনা।
COPYRIGHT © 2020 SATKAHON
খুব ভালো লাগলো পড়ে। অনেক অজানা কথা জানা হোল। আশা করবো ভবিষ্যত প্রজন্মকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে সফল হবেন উনি। আবৃত্তির পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও ঋচা সরকার খুব উঁচু মনের। বিভিন্ন ব্যাপারে সাহায্য পেয়েছি ওনার থেকে। উনি ভালো থাকুন।
বাহ্, খুব ভালো লাগলো। রিচা আমাদের অনেকদিনের বন্ধু। বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে আমাদের একটা সময় প্রায়শই দেখা হতো। তারপর হঠাৎ কবে যেন ও আমাদের সাংস্কৃতিক চৌহদ্দি থেকে কেমন উধাও হয়ে গেলো। ও যে বিয়ের সূত্রে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছে, সেটা অনেক পরে জেনেছি। যাই হোক, পরে ওকে আবার ফেসবুকের সুবাদে বন্ধু হিসেবে ফিরে পেয়েছি। এখন আমাদের ফেসবুকের দেয়ালে মাঝেমাঝেই কথাবার্তা হয়।
ওর এই সাক্ষাৎকার পড়ে খুব ভালো লাগলো। ওর জীবনের অনেক তথ্য জানলাম, যেগুলো আপনার জানা ছিল না। রিচা কে আমার অনেক অনেক শুভেচ্ছা, অভিনন্দন ও ভালোবাসা জানাই।
Thank you so much sir.
Rocha khub valo interview. Tomar swapno safol hok. Valo theko saporibare.
Pingback: Satkahon Review - নজরুলজয়ন্তী উদযাপনে আটলান্টা আবৃত্তিচর্চা - Satkahon