Satkahon Interview – Sayantan Banerjee – Radio Lounge | প্রতিবন্ধকতা যাকে হারাতে পারেনি
Satkahon Interview – Sayantan Banerjee – Radio Lounge
প্রতিবন্ধকতা যে কেবলই মস্তিস্কের অবসর তা নিজের কাজের মাধ্যমে প্রমান করেছেন বিক্রমগড় প্রাইমারী বিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়ন্তন।
ঈশ্বর তাঁকে দৃষ্টিশক্তি না দিলেও তিনি কিন্তু হেরে যাননি। মস্তিস্ককে অবসর নিতেও দেননি।
বরং নিজের সংস্কৃতি প্রেমকে সেতু করেই বাংলা ভাষা ও নতুন বাংলা গানের প্রচারে নিয়ে এসেছেন Radio Lounge… একটি ডিজিটাল রেডিও।
করোনা মহামারী বুঝিয়েই দিয়েছে ডিজিটাল মাধ্যম আমাদের একমাত্র ভরসা। সমস্ত রেডিও ষ্টেশন নতুন বাংলা শোনানো বন্ধ করে দিয়েছে।
এই সময় নতুন বাংলা গানের শিল্পীরা সাদর আমন্ত্রন জানাচ্ছেন এই অনলাইন রেডিও ষ্টেশনটিকে।
দৃষ্টিহীনতার সুযোগ নিয়ে শারীরিক হেনস্থা কিংবা সমাজের অবহেলা যাই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হোক না কেন তাঁর জীবনে তিনি মনোবল হারাননি।
বরং হয়ে উঠেছেন অন্যের মনোবল।
সাতকাহনের সাক্ষাৎকারে আজ সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়…..
কেমন আছেন সায়ন্তন?
খুব ভালো আছি। প্রথমেই বলব সাতকাহনকে অনেক ধন্যবাদ। সাতকাহনের মাধ্যমে আমি আমার কাহিনী সকলের সামনে তুলে ধরতে পারছি।
সাতকাহনের তরফ থেকে আপনাকেও অনেক শুভকামনা জানাই।
সাক্ষাৎকারের শুরুতে যা সবার আগে জানতে ইচ্ছে করছে তা হল আর চার পাঁচ জনের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা ভাবে আপনার জীবন শুরু হওয়া জীবনের গল্পটা…
জীবন প্রত্যেক মানুষের আলাদা। আমি দৃষ্টিহীন, কিন্তু জীবন কে আমি আলাদা করে দেখিনি। আমার মনে হয়েছে আমার বাধা গুলোকে আমাকে অতিক্রম করতে হবে।
কলকাতাতেই আমার জন্ম। কিন্তু সেটা একটু অন্যরকম ভাবেই। সাড়ে ছয় মাসে PRE-MATURE জন্ম আমার। আমাকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না।
অবশেষে কয়েক বছর লড়াই করার পর ডঃ ত্রিদিব ব্যানার্জীর নেতৃত্বে কোঠারি হসপিটালে আমি সুস্থ হয়ে উঠি।
কিন্তু দৃষ্টিশক্তি থেকে ঈশ্বর আমাকে বঞ্চিত করেছেন। তাই পৃথিবীকে আমি চিনেছি শব্দের মাধ্যমে, স্পর্শের মাধ্যমে।
মনে হত সবাই কি সুন্দর দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। কিন্তু কোনোদিন থেমে থাকিনি।
পরিবারকে কতটা পাশে পেয়েছেন?
আত্মীয় স্বজনরা অবশ্যই পাশে ছিলেন, কিন্তু বাবা আর মায়ের মত করে কাউকে পাশে পাইনি।
ছোট থেকে কি হবার স্বপ্ন দেখেছেন?
মানুষ হতে চেয়েছি।
পড়াশুনা কি নিয়ে করেন?
তখন সরকারি বিদ্যালয়ে “সবার জন্যে শিক্ষা” বিষয়টা ছিল না।পাড়ার বিদ্যালয় গুলি ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। পরে “Light House For the blind” বিদ্যালয়টিতে ভর্তি হই।
এরপর ২০০১ সালে “Ramakrishna mission blind boy’s academy” তে ভর্তি হই।
হস্টেল যাওয়া প্রসঙ্গে বাড়িতে একটু আপত্তি থাকলেও বাবা আমাকে বলেন, “তোমার জীবন পদ্ধতির সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। তাই তোমাকে নিজের জীবন গড়তে হবে। শিখতে হবে। Brail পদ্ধতি শিখতে হবে। যার সাথে আমরা সহজাত নই।“
আমার চিকিৎসা করতে করতে অনেকটাই খরচা হয়ে যায়। বাবা T-series এ চাকরি করতেন।
সেই সময় গুলশান কুমার নিজে কলকাতা এসে আমাকে দেখেন ও বাবাকে কোম্পানি থেকে Loan নেবার ব্যবস্থা করে দেন।
পরবর্তীকালে আমি পাঠভবন এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস বিষয়ে পড়াশুনা করি।
সংস্কৃতি জগতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হল কিভাবে?
বাড়ি থেকে।
বাবার চাকরির সুবাদে নানা ধরণের গানের ক্যাসেট আসত আমাদের বাড়িতে। গরমের ছুটিতে বাড়ি এলে গান বাজনা হত।
ছোটবেলা থেকে গান শিখেছি। আর ১০ বছরের হস্টেল জীবনে আমার সাথী ছিল রেডিও। প্রিয় উপস্থাপক আর.জে দীপ।
মজার কথা বলি, ছোটবেলায় ভাবতাম রেডিওর মধ্যে কেউ বসে গান গাইছে, কথা বলছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কমিউনিটি রেডিও আছে। সেখানে যাবার পর, রেডিওকে আমার কাছ থেকে চেনা। তখন স্বপ্ন দেখতাম আমারও একটা রেডিও চ্যানেল হবে।
Radio Lounge প্রসঙ্গে চলে আসি তাহলে… এই অনলাইন রেডিও নির্মাণ এর চিন্তা ভাবনা কিভাবে?
আমার এক বন্ধুর একটি অনলাইন রেডিও ষ্টেশন ছিল Radiobongonet.net. তাঁর সাথে আলোচনা করতে করতেই আমার Radio Lounge তৈরির চিন্তা মাথায় আসে।
এটি বাংলার তথা সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তৃত একটি অনলাইন রেডিও এবং আমাদের একটি application ও রয়েছে google play store – এ।
গত ৮ই মে ২৫শে বৈশাখ আমাদের পথ চলা শুরু। এই ওয়েবসাইটটি যিনি বানিয়েছেন তাঁর নাম প্রদীপ চন্দ্র শিকদার এবং তিনিও সম্পূর্ণ রুপে দৃষ্টিহীন।
আগে তো নতুন গান মানেই রেডিওতে বাজানো হত, কিন্তু এখন অনেক ভালো কাজ হলেও সেই গান রেডিওতে বাজানো হয় না।
Radio lounge কি নতুন গানের প্রচার করবে? কি ধরণের পরিকল্পনা আগামী দিনে?
অবশ্যই করবে আর করছেও।কিছুদিন আগেই আমরা বিশ্ব সংগীত দিবস উদযাপন করলাম।আসছে পুজোর আড্ডা।
আমাদের পুজোর আড্ডায় চারদিনে থাকছেন চার জন শিল্পী যেমন অর্ঘ্য ব্যানার্জী, আর্যা চক্রবর্তী, প্রতিতী চট্টোপাধ্যায়,অ্যানি আহমেদ ও আরও অনেকে।
তাঁদের পুজোর গান নিয়ে হবে জমাটি আলোচনা।
আগামী দিনে আরও নতুন নতুন কাজ নিয়ে আসছি আমরা। বাংলা ভাষার প্রসার, নতুন বাংলা গানের প্রচার করবে Radio lounge.
সায়ন্তন আপনার মতই যারা দৃষ্টিশক্তিহীন তাঁদের জন্যে আগামী দিনে কোন প্রকল্প?
এ প্রসঙ্গে বলি, আমাদের বিদ্যালয় জীবনে লেখক প্রয়োজন হত পরীক্ষা দিতে গেলে।
দশম শ্রেণী পর্যন্ত মিশন থেকে লেখকের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলেও একাদশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিজেদের লেখক খুঁজে নিতে হত।
খুবই অসুবিধা জনক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এটি। আমাকেও সেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
Lighthouse Think different নামে একটি NGO তে আমি যুক্ত। সেখানে স্বেচ্ছায় বিভিন্ন লেখক এবং পাঠকরা যুক্ত হন একটি WhatsApp Group এর মাধ্যমে।
দৃষ্টিহীনদের কিছু পাঠক্রম পড়ে দেওয়া বা পরীক্ষার সময় শুনে লেখার জন্যে অনেকেই সাহায্য করছেন।
জীবনে মনে রাখার মত কোন অভিজ্ঞতা…
অভিজ্ঞতা ভালো খারাপ দুই আছে। আগে খারাপটাই বলি, কলেজ জীবনে কোন এক বৃষ্টির দিনে আমি বাড়ি ফিরছিলাম।
আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবার নাম করে আমার শারীরিক ও মানসিক নানাভাবে হেনস্থা করেন এক মহিলা।
মানসিক ভাবে নিজেকে নিজেই সামলাতে হয়েছিল।
আর, ভালো অভিজ্ঞতা বলব যেদিন প্রথম চাকরি পেয়ে আমার মা কে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম সেদিন মনে হয়েছিল জীবনটা স্বার্থক।
ভালো-মন্দ নানান অভিজ্ঞতা হয়েছে জীবনে, কিন্তু এত কিছুর পরও আমি মনে করি, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। থেমে থাকলে চলবে না।
সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার আমার এই লড়াইতে আমি এগিয়ে চলব আমার মত করেই।
সমাজের উদ্দেশ্যে কিছু বার্তা…
প্রতিবন্দকতা আছে বলেই কাউকে অবহেলা যেমন করা উচিত নয় তেমনই অতিরিক্ত যত্নেরও প্রয়োজন নেই।
শুধু তাঁকে তাঁর যোগ্য জায়গাটা একটু দেখিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ, কোন না কোন জায়গায় প্রতিবন্দি আমরা সবাই।