Satkahon Interview – Manju Chakraborty | Music Teacher

Satkahon Interview - Manju Chakraborty

Satkahon Interview – Manju Chakraborty

সময়ের সাথে সাথে চামড়ার উপর এসে পরে কিছু ভাঁজ। গলার স্বর হয়ে পরে নড়বরে। কিন্তু প্রানে গান থেকেই যায়।

শিল্পী কথাটা এখন বড়ই যেন ব্যবসায়িক হয়ে পড়েছে। আমি শিল্পী অর্থাৎ আমি ব্যবসায়ী।

অবশ্যই শিল্পের মুল্য দেওয়া উচিত।

কিন্তু আজকালকার দিনে যেন কোথাও কেবল মাত্র মুল্যের নিরিখেই শিল্পের বিচার করা হয়।

তাই, এমন এক মানুষের কথা আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব, যিনি সারা জীবন বিনা পারিশ্রমিকে সংগীত শিক্ষা বিতরণ করেছেন তাঁর সন্তানসম ছাত্র ছাত্রীদের।

নাম যশ পাওয়ার অন্ধযুদ্ধে তখনও বাঙালীর যাত্রা শুরু হয়নি।

দেশ সেবায় নিমজ্জিত পরিবারে জন্ম নিয়ে এবং ঋষি অরবিন্দের শিক্ষাকে পাথেয় করেই তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠা।

সাতকাহনের সাক্ষাৎকারে আজ শ্রীমতী মঞ্জু চক্রবর্তী।

আপনার বাবা এবং দাদু দুজনেই স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।

গান জীবনের গল্পে আসার আগে তাই আপনার থেকে জানতে ইচ্ছে করছে আপনার বড় হয়ে ওঠার গল্প….

আমার মামার বাড়ি দক্ষিন ২৪ পরগনার বহরু তে। দাদু ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। বাবার বাড়ি চট্টগ্রাম, গোমদন্ডি।

সেখান থেকে বাবা চন্দননগর চলে আসেন। তখন চন্দননগর ছিল ফরাসি রাজত্ব। চন্দননগরে তখন ছিল অনুশীলন সমিতি।

ঋষি অরবিন্দ এর নামকরন করেন প্রবর্তক সংঘ। সেখানে ছেলেদের শরীর চর্চা থেকে উচ্চ শিক্ষা সব রকম ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত করা হত।আমার বাবাও সেখানে যুক্ত ছিলেন।

বন্দেমাতরম ছিল তাঁদের একমাত্র মন্ত্র। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি,

ভিতরে ভিতর খবর পাওয়া গেলো বার্মা থেকে জাহাজে করে ইংরেজদের অস্ত্র আসছে।

বাংলায় তখন অস্ত্রের কারখানা ছিল না, তাই ওদের অস্ত্র দিয়ে ওদের জবাব দেওয়াই ছিল একমাত্র পথ।

সেই সময় সুন্দরবনের নোনাঘেরি, অমরাবতি অঞ্চলে জঙ্গল কাটার প্রকল্প নিয়ে এসেছিলেন ফ্রেজার সাহেব।

যার নাম অনুসারে বর্তমানে সেই জায়গার নাম হয়েছে ফ্রেজারগঞ্জ। সেখানে কাজ করার জন্যে দরকার পড়লো কিছু কন্ট্রাক্টর ও মজুর দরকার।

তখন অনুশীলন সমিতির সেই উচ্চশিক্ষিত ছেলেদের অশিক্ষিত কন্ট্রাক্টর সাজিয়ে সেই কাজে নিযুক্ত করা হল।

যাতে সাহেবরা ইংরাজিতে অস্ত্র আনার কথা বললে তারা গোপনে সেই খবর সমিতিকে দিতে পারে। সেই দলে আমার বাবাও ছিলেন।

আমার মায়ের বাবা ছিলেন বহুরুর পোস্ট মাস্টার। তাঁর কাজ ছিল চিঠি পত্রের আদান প্রদান করে দেওয়া।

এমনকি আমার মেজ মামাও এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাটা কোম্পানির সেলস ম্যানেজার।

ওনার কাজ ছিল কোম্পানির জুতোর তলায় চিঠি পাচার করা।

এই ভাবে মা ও বাবার বিয়ে হয়। মা ছিলেন সঙ্গীতের অনুরাগী।

মা নিজে গান গাইতেন, কথামৃত থেকে মা নাটক লিখতেন আমরা ভাইবোনরা অভিনয় করতাম।

মা নিজে যে খুব পড়াশুনা করেছিলেন তা নয়, কিন্তু মা বলতেন মানুষের শিক্ষার দরকার। নইলে পশুর সাথে ভেদাভেদ কি থাকবে?

মায়ের থেকেই আমার গান শেখা।

আমি প্রবর্তক থেকেই উচ্চমাধ্যপমিক পাস করি। পরে মনীন্দ্র কলেজে পড়াশুনা করি।   

মায়ের থেকেই কি তাহলে গান শিখেছেন?

পরবর্তীকালে স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্রের সংস্পর্শে আসি। সে ও এক কাহিনী।

দিদি তখন গান শেখাতেন আমাদের বোর্ডিঙের পাশে এক বাড়িতে। আমি ছাদে উঠে সেই গান শুনতাম। শুনে শুনে শিখতাম।কিন্তু আমি জানতাম না যে গান শেখাচ্ছেন সুচিত্রা মিত্র।

একবার বোর্ডিঙের এক অনুষ্ঠানে দিদি আসেন। আমি সেখানে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করি।গেয়েছিলাম “আমি কান পেতে রই”।

মঞ্চ থেকে নামার পর দিদি জিজ্ঞেস করলেন কার থেকে আমি এই গানটা শিখেছি। আমি বললাম, একজন আসেন আমাদের বোর্ডিঙের পাশের বাড়িতে গান শেখান। আমি ছাদে উঠে শুনে শুনে শিখেছি।

উনি বললেন সে কি তুমি শুনে শুনে শিখেছ এত ভালো? আমি বললাম হ্যাঁ, আমি তো অনেক গান শিখেছি ওনার থেকে শুনে।

তখন আমাদের অন্যান্য দিদিরা বলে দিলেন উনিই সেই শিক্ষিকা এবং উনি কত গুণী শিল্পী তখন আমি জানতে পারলাম।

উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব আশীর্বাদ করেছিলেন আর নাম দিয়েছিলেন সুন্দরবনের বাঘ।

পরবর্তীকালে কলকাতায় আসার পর আমি রবিতীর্থতে দীর্ঘদিন ওনার কাছে শিখেছি।

বিনা পারিশ্রমিকে আপনি দীর্ঘদিন সংগীত শিক্ষা দিয়েছেন …

বিয়ের আগে আমি চাকরি করতাম।

বিয়ের পর শশুর মশাই বললেন, তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ কিন্তু গানটা ছেড়ো না। তখন আমি বাড়িতে গান শেখাতে শুরু করলাম। ব্যারাকপুরে আমি ৯ বছর গান শিখিয়েছি।

এর পর স্বামীর চাকরি সুত্রে বদলি হয়ে যাওয়ায় কাকদ্বীপ চলে আসতে হয়। কাকদ্বীপ সেই সময় ছিল পান্ডব বর্জিত এলাকা।

এদিকে আমার মেয়ে চন্দ্রা (Chandra Chakraborty), বর্তমানে সঙ্গীতজগতে সুপ্রতিষ্ঠিত, ওর তখন আট বছর বয়স, তখন আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষে ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে নজরুলগীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীতে।

তার এই গুনকে আমি কিছুতেই শেষ হয়ে যেতে দিতে পারিনা। তাই কাকদ্বীপ থেকে কলকাতা যাতায়াত করতাম ওর গান শেখার জন্যে।

তখন কাকদ্বীপে পুরুষ প্রশিক্ষকের কাছে গান শিখতে অনেকেই আপত্তি করত। আমি যখন গান শেখাতে শুরু করলাম তাই আমার ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা হয়ে দাঁড়াল বিশাল।

কিন্তু মা বলতেন সংগীত ঈশ্বরের সাধনা। বিক্রি করার বিষয় নয়। তাই কোনদিনই পারিশ্রমিক নেবার কথা মনে হয়নি।

শিক্ষার্থীদের থেকে যে সম্মান পেয়েছি সেটাই আমার গুরুদক্ষিনা।

এই যে বিপুল জীবন দর্শন সেই দর্শন থেকে সমাজ কে কি বার্তা দেবেন?

খুব সামান্য একটা কথাই বলব যেটা কিন্তু মেনে চলা শক্ত।

যার যা ভাললাগে সেটাই করুক কিন্তু যেকোন কাজই খুব পবিত্রভাবে সৎ ভাবে করতে হবে। কারণ মানুষ থাকবে না, কাজটা থেকে যাবে।

COPYRIGHT © 2020 SATKAHON

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *