Satkahon Interview – কাকলী মুখার্জী (সঙ্গীতশিল্পী) | দুর্গাপুর আনন্দমেলা
Satkahon Interview – কাকলী মুখার্জী
কখনো কখনো মনের সাথে মস্তিস্কের দ্বন্দ শেষে বিরহ- ব্যথার মোড়ক সরিয়ে জন্ম নেয় সংগীত। সেই সঙ্গীতই শক্তি।
আর সেই শক্তিকেই নিজের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন সঙ্গীতশিল্পী কাকলী মুখার্জী। তাঁর সেই জীবন গল্পই তিনি ভাগ করে নিলেন সাতকাহনের সাক্ষাৎকারে।
দুর্গাপুরে জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা তাঁর। বাবা মা গান বাজনা না করলেও ছিলেন সংগীতপিয়াসী।
দাদা সঞ্জীত মুখার্জী সঙ্গীতপ্রেমী এবং গুণী তবলা বাদক, সুতরাং মেয়ে হিসেবে বাবা-মা ছেয়েছিলেন কাকলী গান শিখুন,দাদার সঙ্গীত চর্চা তাঁকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল সঙ্গীতানুরাগী হয়ে উঠতে।
খেয়াল গান দিয়ে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেছিলেন তিনি। প্রথম গুরু পণ্ডিত সমরেশ চৌধুরী এবং পণ্ডিত দীননাথ মিশ্রা।
সপ্তম শ্রেনীতে পড়াকালীনই আকাশবাণীতে বি-গ্রেড পদ অর্জন করেন নজরুল গানে। এরপর দীর্ঘদিন গান শিখেছেন স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী শ্রীমতী শিপ্রা বসুর কাছে।
শ্রীমতী বসুর কাছে শেখার পর থেকেই ঠুমরী গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মায়।
দাদার সাথে দুর্গাপুর থেকে কলকাতা আসতেন গান শিখতে। ছোটবেলায় সেইভাবে আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় দুর্গাপুর থেকে কলকাতা রোজ যাতায়াত করতে হত তাঁদের, কারণ কলকাতা এসে থাকা সেই সময় সম্ভব ছিল না।
কিন্তু মনে প্রানে যখন সঙ্গীত তার জায়গা জুড়ে বসে, তখন কোন প্রতিকুলতাই বাধা হয়ে উঠতে পারে না।
ডোভারলেন মিউজিক আকাদেমির সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ঠুমরী বিভাগে প্রথম হলেন তিনি।
বাবা চাকরি থেকে ইচ্ছা অবসর নিলেন। সেই সময় ঠুমরী গানে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেলেন নবম শ্রেনীর ছাত্রী কাকলী।
একাদশ শ্রেনী থেকে পড়াশুনা এবং গানের খরচা চালানোর জন্যেই শুরু করলেন গান শেখানো।
তাঁর সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান “সুরমন্দির” এর বর্তমান ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৮০।
ভাগ্যের পরিহাসে জীবনে নানা ঝড় নেমে আসে তাঁর জীবনে। মানসিক বিপর্যয় তাঁকে সাঙ্গীতিক পটভূমি থেকে সরিয়ে আনে।
কিন্তু যা ভালোবাসায়, পরিশ্রমে তৈরি তার প্রতি টান এক নিমেষে শেষ হয়ে যেতে পারে না। বললেন,
২০১০ এ আমি মেয়েকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাই কলকাতা। তখন দুর্গা যশরাজজীর আয়োজনে আইসিসিআরে আইডিয়া জলসা নামক একটি প্রতিযোগিতায় আমি যোগদান করি এবং মুম্বাই যাবার সুযোগ পাই।
আমার সামনে বসে আছেন হরিহরণজী, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চোউরাসিয়া, পণ্ডিত যশরাজজী। আমি ঠুমরী পরিবেশন করলাম। হরিপ্রসাদজী গান শুনে বললেন “তুমহারে আন্দার কুছ তো দর্দ হে বেটা” সেটা আমার খুব স্মরনীয় একটা মুহূর্ত। আইডিয়া জলসা থেকে আমি প্রথম স্তরের স্কলারশিপ পাই। অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হয় জি টিভি থেকে।
এরপর, ২০১১ তে আবার আমি দিল্লি যাই মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে। সেখানেও আমার এক বন্ধু আমাকে জানাল যে দিল্লীতে একটি প্রতিযোগিতা চলছে। অনুষ্ঠান টির নাম ছিল গিরিজা দেবী পুরস্কার (VSK BAITHAK).
অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যক্তা ছিলেন বিনোদ কাপুর।
অপ্রতাশিত ভাবে আমি গিরিজা দেবী পুরস্কার পেলাম।
সেই অনুষ্ঠানের পর আমাকে প্রতি মাসে নিজের ফান্ড থেকে স্কলারশিপ দেবার ব্যাবস্থা করেন বিনোদ কাপুর। এমনকি উনি নিজে আমাকে আপ্পাজী অর্থাৎ শ্রীমতী গিরিজা দেবীর কাছে ভর্তি করে দেন।
আমার গান জীবনে ফিরে আসার জন্যে ওনার অবদান অনস্বীকার্য। এমনকি এখনও উনি বাবার মত আমার পাশে রয়েছেন।“
দুর্গাপুরে ফিরে আসার পর বেশ কয়েকজনের উদ্যোগে ঘরোয়া গানের জলসা বা বৈঠক থেকে একটি সাঙ্গীতিক আনন্দ উৎসব তৈরির উদ্যেশ্য নিয়ে তৈরি হয় দুর্গাপুর আনন্দমেলা,কাকলী নিযুক্ত হন সম্পাদিকা পদে।
এই অনুষ্ঠান আলোকিত করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শ্রীমতী অদিতি মহসিন, বিশিষ্ট তবলা বাদক শ্রী তন্ময় বোস, স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী শ্রী রশিদ খান ও আরও অনেকে।
শুধু সাঙ্গীতিক অনুষ্ঠানই নয়, দুর্গাপুর আনন্দমেলা বিভিন্ন সামাজিক কাজ কর্মের সঙ্গেও যুক্ত।
২০২০ মহামারীর দিনেও তারা প্রায় ২০০ জন শিল্পীকে মাসিক রেশন প্রদান করেছেন।
এমনকি ডিজিটাল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দুর্গাপুর আনন্দমেলা একাধিক শিল্পীকে উপযুক্ত সাম্মানিক প্রদান করে তাঁদের সোশ্যাল পেজে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্যে আমন্ত্রন জানাচ্ছেন।
বর্তমানে নজরুল গানে ‘বি হাই’, ঠুমরী তে ‘এ’ এবং ভজনে ‘বি-গ্রেড’ তিনি আকাশবাণীতে।
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতের অতিথি প্রভাষক তিনি। এছাড়াও দুর্গাপুর নির্ঝর উচ্চবিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে শিক্ষকতা করছেন শ্রীমতী কাকলী মুখার্জী।
জীবনে নানা ওঠাপড়া এবং বিষাদ থাকা সত্ত্বেও সঙ্গীত যেমন তাঁর হাত ছাড়েনি, তেমনই তিনিও সাধ্যমত পাশে থেকেছেন শিল্পের।
তাঁর জীবন গল্পের বিশেষত্ব হয়ত এখানেই যে তিনি লড়াই করে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা মানুষদের অন্যতম অনুপ্রেরণা।