Satkahon- Chandra Chakraborty|সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তী
Satkahon– Chandra Chakraborty
গুরুগৃহে থেকে গান শেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর, একদিকে পাশে পেয়েছেন জন্মদাতা-জন্মদাত্রী বাবা-মাকে, অন্যদিকে মেয়ে বলে ডেকে দুহাতে আগলে নিয়েছেন স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত এ. কানন ও মালবিকা কানন। যাদের একফোঁটা চরণধুলিতে উদ্ধার হয়ে যায় শিল্প জীবন, তাঁদের কোলের মেয়ে ছিলেন তিনি।একের পর এক স্মৃতি ভিড় করে এসেছে তাঁর কথায়। আসুন জেনে নিই কেমন ছিল তাঁর গুরুগৃহ যাপন…কেমন ছিল গুরুমা-গুরুজীর স্নেহ…
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ৬ বছরের বালিকা
পশিমবঙ্গের দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলার কাকদ্বীপে বড় হয়ে ওঠা তাঁর, বাবা রঞ্জন চক্রবর্তী ছিলেন Indian Council of Agricultural Research এর প্রধান বিজ্ঞানী। রিসার্চ এর কাজের জন্যেই তাঁকে কলকাতা থেকে কাকদ্বীপে বদলি হয়ে আসতে হয়। বাড়িতে গান বাজনা চলত সারাদিন, কারণ মা মঞ্জু চক্রবর্তী ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্রের প্রিয় ছাত্রী। তাই সুর পেয়েছেন মায়ের উত্তরসুরি হিসেবে, মাত্র ৩ বছর বয়স থেকেই যেকোনো গান একবার শুনে হুবহু গেয়ে দিতে পারতেন চন্দ্রা।মাত্র ৫ বছর বয়স থেকে নিজে নিজে হারমোনিয়াম বাজাতেন তিনি।
কাকদ্বীপে চলে যাবার আগে বাবা মার সাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে গেছেন গান শুনতে, বায়না ধরে বসলেন তাকেও গান গাইতে দিতে হবে। উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করতে তাঁরা তাঁকে মাননীয় শিল্পীদের আগে একটি মাত্র গান গাইবার অনুমতি দেন। মঞ্চে উঠে ৫ বছরের ছোট্ট মেয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ৬ টি গান পরিবেশন করে, তা শুনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর বাবাকে ডেকে বলেন, “ওর খুব ভালো তালিম দরকার, ওকে ভালো করে গান শেখান।“
“কাকদ্বীপ এ চলে যাবার পর একটি অনুষ্ঠানে আমার গান শুনে শ্রদ্ধেয় অমরেশ চৌধুরীর ছাত্র এক অন্ধ ভদ্রলোক, নাম ঝন্টু দাস তিনি আমাদের বাড়িতে আসেন, এবং আমাকে খেয়াল শেখাতে চান। সেই আমার খেয়াল শেখার শুরু। ছোটবেলা থেকেই আমার মনে হত আমিও মঞ্চে গান গাইব, গানের বাইরে কিছু করার কথা কোনোদিনও আমার মনে আসেনি “
শ্রীমতী কল্যানী কাজী ও চিচিং ফাঁক
৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক শিশুবর্ষের সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, ও রাগপ্রধান বিভাগে যোগ দিয়ে প্রত্যেক বিভাগে প্রথম হন তিনি। সেখানে তাঁর গান শোনেন শ্রীমতী কল্যানী কাজী ও জিজ্ঞাসা করেন তিনি কার কাছে এত ভালো গান শিখেছেন? মা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেও নজরুলগীতি রেডিও বা বাবার কিনে আনা ক্যাসেটে শুনে শিখেছেন জেনে তিনি অবাক হন ও তাঁকে পরের বছর যুববর্ষে সর্বসাধারণের বিভাগে গান গাইতে বলেন, এমনকি ৭ বছরের বালিকা কে উদ্যোক্তারা সেই অনুমতি না দিলেও কল্যাণী কাজী নিজে অনুরোধ করেন, এবং সর্বসাধারণের রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি দুই বিভাগেই প্রথম হন চন্দ্রা।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা দূরদর্শনের কিছু নামী ব্যাক্তি, তাঁরা তাঁকে নিয়ে দূরদর্শনের চিচিং ফাঁক ধারাবাহিকে একটি একক অনুষ্ঠান করলেন। সেই থেকেই তাঁর পরিচিতির সুত্রপাত হতে শুরু করলো।
সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমি [ITC Sangeet Research Academy]
কাকদ্বীপের একরাত ব্যাপী একটি অনুষ্ঠানে বাবা মা-র সাথে গিয়েছিলেন সঙ্গীত পরিবেশন করতে।তখন তাঁর বয়স ১০। সেখানে তাঁর গান শুনে শ্রী অরুণ ভাদুরি তাঁর বাবা মা কে বলেন, কলকাতা সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমিতে যোগাযোগ করতে।সেই সময় সেখানে ডিরেক্টর ছিলেন পদ্মশ্রী প্রাপ্ত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী বিজয় কিচলু (Vijay kichlu)। প্রথম পরীক্ষাতেই চন্দ্রার গলায় একটি খেয়াল শুনে তাঁকে সম্পূর্ণ বৃত্তি দিয়ে আকাদেমিতে রাখতে চান তিনি, কিন্তু ১০ বছরের মেয়ে একলা থাকবে, তাই নিয়ে সহমত হননি বাবা মা, এমনকি তিনি পরিবারের সকলকে থাকার ব্যাবস্থা করে দিতে চাইলেও বাবা রাজি হননি কারণ তাঁর রিসার্চ ছেড়ে সেই সময় কলকাতা থাকা তাঁর সম্ভব ছিল না। তাই দৈনিক বৃত্তি নিয়ে যাতায়াত চলতে থাকে কাকদ্বীপ থেকে কলকাতা। যেতে আসতে সাড়ে ৫ ঘণ্টা করে সময় লাগলেও সঙ্গীতের জন্যে এই পরিশ্রম ছিল তাঁর ভালোবাসা।
তবে, মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তিনি আকাদেমিতে থাকতে শুরু করেন, ৬ মাস হস্টেলে থাকেন এবং তারপরই গুরুমা তাকে নিজের কাছে ডেকে নেন।
গুরুমা-গুরুজী ও ছয় তারের তানপুরা
আকাদেমিতে পণ্ডিত এ. কানন (Pt. A. Kanan) এর কাছে গান শেখা শুরু হয় তাঁর কিন্তু আকস্মিক পন্দিতজীর ক্যান্সার ধরা পরে। তাঁর ছাত্র ছাত্রীদের অন্য গুরুর আশ্রয় নিতে হয়, সবাই চলে গেলেও গুরুজী ছাড়তে চাননি ছোট্ট চন্দ্রাকে, কারন মেয়ে ডেকে ছিলেন তাকে তিনি। তাই ঠিক হল, গুরুমা মালবিকা কাননই (Smt Malabika Kanan) তাকে গান শেখাবেন। আকাদেমির শিক্ষিকা না হয়েও বিনা পারিশ্রমিকে তাকে গান শিখিয়েছেন তিনি ১ বছর।
“এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা যে, গুরুমা আমার মাথায় হাত রেখে তাঁর বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, বাবি, তুমি যেমন কিছু না চেয়ে যেমন আমাকে শিখিয়েছো, তেমনই তোমার নাম করে আমি এই ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে তুলে নিলাম।”
আমি গুরুজীর বাড়ি থাকছি, কিন্তু গুরুজীকে আমি এতটাই ভালবাসতাম যে আমার কখনো মনে হয়নি আমি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও রয়েছি। তখনও গুরুজী সম্পূর্ণ সুস্থ হননি, কিন্তু গুরুমা যতটা আমার খেয়াল রাখতেন গুরুজীও তত টাই।আমি জলখাবারে কি খাবো তিনি ঠিক করতেন।খেয়াল রাখতেন যে আমার পছন্দের একটি পদ রোজ রান্না হল কিনা, আমি মুরগি খেতে ভালো বাসতাম,মুরগি রান্না হলে আমাকে তাই নিজে হাতে ভাত বেড়ে দিতেন তিনি। নিজে হাতে চিংড়ি মাছ রান্না করে ভাত মেখে খাইয়ে দিতেন আমাকে, দক্ষিন ভারতের একটা ঝাল আচার মাখতেন ভাতে, আমি সেটা খেতে চাইতাম না কিন্তু উনি আদর করে বলতেন “ খাও রে খাও রে একটুখানি খাও রে” শেষে একদিন আমি বললাম আমি এত ঝাল খেতে পারছি না, তখন উনি আমাকে আমের চাটনি মেখে নিজে হাতে ভাত খাইয়ে দিলেন। আসলে আমাকে নিজে হাতে খাইয়ে দেওয়াটাই ওনার কাছে আনন্দ ছিল। এখনও আমি যখন চিংড়ি মাছ খাই আমার চোখে জল এসে যায়।
পুজোর সময় ষষ্ঠীর দিন সকালে উনি আমাকে দক্ষিনাপন থেকে জামা কিনে দিতেন, ওনার ইচ্ছে ছিল বিকেলে আমি কাকদ্বীপ বা গুরুজীর বাড়ি যেখানেই থাকি না কেন আমি যেন ওই জামাটা পরি। দক্ষিন ভারত গেলেই গুরুজী আমার জন্যে গোকুলের স্যান্থল পাউডার আনতেন, তার শেষ কৌটোটা এখনও আমার কাছে আছে।
অনেক কথা বলে শেষ হবে না, গুরুজীকে নিয়ে লেখা আমার বই ‘ছয় তারের তানপুরা’, সেখানে আমি সবটাই লেখার চেষ্টা করেছি, খুব তাড়াতাড়ি সেটি মুক্তি পাবে।
তানপুরা সাধারণত চার তারের হলেও গুরুমা সারা বিশ্ব ঘুরেছেন যে তানপুরা নিয়ে সেটি একটি ছয় তারের তানপুরা। সেটি উনি আমাকে দিয়ে গেছেন, এমনকি গুরুজী তাকে ফুলসজ্জায় যে আংটিটি দিয়েছিলেন সেটি এবং তাঁর বাবার বিয়েতে দেওয়া কানের দুলও আমাকে দিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, গুরুমার পছন্দের ছেলের সাথে উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার বিয়ে দেন।
আমার শত জন্মের সৌভাগ্য যে আমি শুধু তাঁদের সংস্পর্শই নয়, তাঁদের এই পরিমান স্নেহ পেয়েছি, যা বোধহয় আর কেউ পায় নি। এই সৌভাগ্য শুধু আমার নয়, আমার বাবা মায়েরও।
ঠুমরী
স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক পান অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে। পরিদর্শন প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছেন জোহানেসবার্গ এর মেফেয়ার স্কুল অফ মিউজিক ও লেনেসা স্কুল অফ মিউজিক -এ।প্রধান অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ইন্ডিয়ান কন্সুলেট, জোহানেসবার্গে। এছাড়াও বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেছেন।
সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমি থেকে শুরু করে একাধিক মঞ্চ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন কুইন এলিজাবেথ এর জন্যেও।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু গানের অ্যালবাম যমুনা কে তীর, চন্দ্রা- অ্যালবাম অফ ঠুমরী, ওম ইত্যাদি।
তাঁর ছাত্র ছাত্রী ছড়িয়ে রয়েছে ভারতবর্ষ, সাউথ আফ্রিকা, আমেরিকা, লন্ডন প্রমুখ দেশ জুড়ে।
বর্তমানে ঠুমরী নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি।
কলাকার আর্টস [ Kalakar Arts ]
Saudha Society of Poetry and Indian music -এর আয়োজনে বেগম আখতারের জীবনী নিয়ে তাঁর লেখা চিত্রনাট্য সাড়া ফেলেছিল সমগ্র লন্ডন শহরে। তখন ছাত্র ছাত্রীরা বলেন নিজেদের একটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থাকলে তাঁদের এই ধরনের অনুষ্ঠান করতে সুবিধা হয়, সেই থেকেই জন্ম নেয় কলাকার আর্টস। কলাকার শুরু হবার পর বেগম আখতারের জীবনী নিয়ে দুটি ও মিয়াঁ তানসেনের কন্যা সরস্বতীর জীবনী নিয়ে একটি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় তাঁদের উদ্যগে,এবং সেগুলিও জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছায়।ভারত সহ বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে চর্চিত হয় তাঁর এই কাজ।
এই মুহূর্তে বিশ্ব মহামারীর প্রকোপে (COVID-19) ডিজিটাল ভাবে কলাকার থেকে পালিত হচ্ছে পণ্ডিত এ. কানন এর জন্ম শতবার্ষিকী। কলাকার এর এই উদ্যোগে অংশগ্রহন করেছেন পণ্ডিত তন্ময় বোস, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ন মজুমদার, উস্তাদ রশিদ খান, শুভঙ্কর ব্যানার্জী, শ্রাবণী সেন, মুরাদ আলী খান, অনুপ জালোটা, দেবাশিস ভট্টাচার্য, শাহিদ পারভেজ আরও অনেক বিভিন্ন গুণী সঙ্গীতশিল্পী। নবীন প্রজন্মের গুণী শিল্পীরাও অংশ গ্রহন করেছেন এই ডিজিটাল অনুষ্ঠানে।
আগামী দিনে মাসে দুটি করে এই ডিজিটাল অনুষ্ঠান চলবে, এবং সেই অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত নামী সঙ্গীতশিল্পীর পাশাপাশি অংশগ্রহন করবেন নবীন শিল্পীরা।
গুরুর স্নেহ পাওয়া আর ঈশ্বরের স্পর্শ পাওয়া দুই বোধহয় সমান, আর যিনি ঈশ্বরের ছোঁয়া পেয়েছেন তিনিই দিতে পারেন সঠিক পথের দিশা। আগামী দিনে তাঁর হাত ধরে কলাকার আর্টস বিস্তার লাভ করবে সমগ্র বিশ্বে, তানসেনের কন্যা সরস্বতীর জীবনী কিংবা বেগম আখতারের না জানা গল্প, তাঁর হাত ধরে জানবে সমগ্র বিশ্ব, প্রবীন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর পাশাপাশি নবীন শিল্পীদের সুযোগ, সম্মান এবং সাম্মানিক দেওয়ার ইচ্ছাকে জানাই কুর্নিশ।
COPYRIGHT © 2020 SATKAHON
পুরো সাক্ষাৎকার পড়ে শুধু এইটুকু বলবো, শ্রীমতি চন্দ্রা চক্রবর্তী সঙ্গীতের মানসী কন্যা। দেবী সরস্বতী যাঁকে নিজ হাত দিয়ে কণ্ঠ সাজিয়ে দিয়েছেন। ঠিক চাঁদের মতোই তাঁর সঙ্গীতের কিরণ। যে কিরণে আজ আমিও মুগ্ধ। আরো মুগ্ধতা তাঁর মুখশ্রী। সুন্দর সাবলীল উপস্থাপনা আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছে। এমন গুণী শিল্পীর শাস্ত্রীয় স্বনামধন্য গুরুজি ও গুরু মায়ের জন্য রইল নমস্কার এবং তাঁদের বিদেহী আত্মার জন্য শান্তি কামনা। চন্দ্রা দি’র উত্তরোত্তর সাফল্য ও বিস্তার কামনা করছি পাশাপাশি কামনা করছি কালাকার-এর সমৃদ্ধি। ধন্যবাদ ॥
Pingback: Satkahon Review - Kalakar Arts ও বিশ্বব্যাপী অভিনব ডিজিটাল অনুষ্ঠান
Pingback: Satkahon Interview - Manju Chakraborty | Music Teacher