Sampa Biswas | Sunday Exclusive | Satkahon

Sampa Biswas | Sunday Exclusive | Satkahon
“শুধুমাত্র যে একজন সঙ্গীতশিল্পী লোকগান গান বাঁচিয়ে রেখেছেন তা নয়, সহকারী যন্ত্র সঙ্গীত শিল্পীরাও কিন্তু এই গানের ধারক – বাহক। তাই নতুন গানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শব্দ গ্রহনে নয়, দৃশ্যায়নেও যন্ত্রানুসঙ্গ রাখতে হবে।রাখতে হবে মঞ্চেও।
ঢোল, ধামসা, মাদল, দোতারা না থাকলে লোকগানও হারিয়ে যাবে।
ফিউশন হোক ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিয়ে।
সব মিলিয়েই লোকগান, যে গান প্রকৃতির গান, যারা গায় তারা মাটির কাছাকাছি না থাকলে হবে কি করে?”
Sampa Biswas
টালিগঞ্জ বিষ্ণুপল্লীতে বড় হয়ে ওঠা ছোট্ট মেয়েটির বাস আজ বাংলার তথা বিশ্বের মানুষের হৃদয়ে।
জনপ্রিয়তার আকাশ ছুঁয়েও সাধারণ জীবন যাপন করেন তিনি।
খ্যাতি শব্দের সাথে দহরম মহরম নেই তাঁর। গুরুর কৃপা আর মাটির কাছাকাছি থেকে শুধু প্রানভরে গান গেয়ে যাওয়াই তাঁর ইচ্ছে।
সাতকাহনের সাক্ষাৎকারে ভাগ করে নিলেন মনের কথা…

নমস্কার দিদি, প্রথমেই জানতে চাইব আপনার ছোটবেলার কথা।
জানব কিভাবে গানের প্রতি আপনার ভালোবাসা তৈরি হল…
আমার বড় হয়ে ওঠা মামার বাড়িতে। সেখানে আমার বাড়ির গুরুজনেরা, আমার বড় দিদা, দাদু সবাই ওপার বাংলার মানুষ ছিলেন।
আমি শুনতাম আমার বাড়ির সামনে একজন বৈষ্ণবী এসে প্রভাতী গান শোনাচ্ছেন।
বা, আমার বড় দিদা হয়ত চৌকাঠে জল দিতে দিতে একটা প্রভাতী গান গাইছেন।
আমার বাড়ীতে একটা গানের পরিবেশ ছিল,আমার মাসি গান গাইতেন, এখনও গান করেন।
সত্যি বলতে কি ‘সা’ শোনার আগে লোকগান শুনে বড় হয়ে উঠেছি আমি।
প্রথম জীবনে কার কাছে গান শেখা?
একেবারে শুরুতে তো বললামই আমার বাড়ির পরিবেশেই আমার শেখা। এছাড়া আমার মাসির কাছে আমি গান শিখেছি।
এর পর আমি বহু গুনী মানুষের সান্নিধ্যে গান শিখেছি। কিছু নাম বলতে বাদ পড়ে গেলে গুরুকে অসম্মান করা হবে, তবু বলি,
প্রথাগত তালিম যাঁদের হাত ধরে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শ্যামল মুখোপাধ্যায়, সুরঞ্জনা বসু, অনুসুয়া মুখোপাধ্যায়।
পাশাপাশি আমি লোকগানের তালিম নিয়েছি পূর্ণ দাস বাউল, গীতা চৌধুরী, আর্যা চৌধুরী, শুভেন্দু মাইতি, জয়ন্ত কুমার বর্মন, রঞ্জিত চক্রবর্তী আরও অনেক গুনী মানুষের থেকে।
মানুষ বলবে আমি এতজনের কাছে লোকগান শিখেছি, এর কি প্রয়োজন?
কিন্তু বিষয় হল আমরা এক এক জনের কাছ থেকে এক একটা বিষয়ে জানতে পারি।
প্রত্যেক গুরুর সান্নিধ্যে এসে জেনেছি তাঁদের আলাদা আলাদা জীবন দর্শন, আলাদা আলাদা গায়কী।
মঞ্চ পরিবেশনা, কিভাবে নিজের শ্রোতা তৈরি করা যায় এগুলো শিখেছি। যেহেতু আমরা মঞ্চে কাজ করি আমার মনে হয় এগুলো শেখা ভীষণ জরুরী।
এমনও হয়েছে আমি সরাসরি শিখিনি কিন্তু একজনের মঞ্চ পরিবেশনা দেখে শিখেছি কিভাবে মঞ্চে গান গাইতে হয়।
কথায় আছে না, “যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন…”
ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকম। কেউ যদি শিখতে চায় তাকে প্রতি মুহূর্তে চারপাশের পরিবেশ,সমাজ, সব ইন্দ্রিয় দিয়ে শিক্ষা গ্রহন করতে শিখতে হবে।
গুরুদের থেকে পাওয়া জীবনদর্শন কিছু যদি আমাদের সাথে ভাগ করে নেন…
এই প্রসঙ্গে ডঃ স্বপন মুখার্জী স্যার এঁর কথা একটু বলি, এই কথাটা আমাকে একসময় ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
একটু গান শিখেই আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেকে ভাবতে থাকে কবে মঞ্চ পাবো, আমরা কিন্তু মঞ্চ পাওয়ার জন্য কেউ গান শিখতাম না।
স্যার আমাকে বলেছিলেন, তুমি যেখানে গান গাইবার জন্যে নিমন্ত্রিত সেখানে তুমি গানের দিকেই মন দেবে। কে তোমাকে পাত্তা দিল না কে পছন্দ করল না সেই দিকে মন দেবে না।একদিন সময় তোমাকে সবটা বুঝিয়ে দেবে।
ওনার এই কথাটা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
কি পেলাম কি পেলাম না সেটা না দেখে আমাদের কাজটা করে যেতে হবে।
সঙ্গীত তো গুরুমুখী বিদ্যা। কিন্তু এখন অনেকেই ডিজিটাল মাধ্যমকে আশ্রয় করে গান শিখে ফেলছে।
লোকগান যা একেবারেই গুরু নির্ভর সঙ্গীত সে ক্ষেত্রে গুরুকে অবহেলা করে কেউ কেউ ভাবছে …লোক সঙ্গীত যে কেউ গাইতে পারে… কি বলবেন?
ঠিক। লোকসঙ্গীতের কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। যেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতির ক্ষেত্রে আছে। লোকগানের যাপন বা তার বয়ে বেড়ানোই হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে।
মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠেই লোকগানের বিচরণ।
এই বিচরণের সময় একটা গান অনেক পাল্টে যায়।
যে গুরুর ছায়ায় থাকে সে এই বিচরণের পরিবর্তনটা বুঝতে পারে। যা ডিজিটাল মাধ্যমে উপলব্ধ নেই।
ডিজিটাল মাধ্যম মানুষকে আনন্দ দিতে পারে। শেখাতেও পারে। কিন্তু সবটা তো নয়।
গান শোনা আর গান গাওয়ার মধ্যে একটা বিস্তর ফারাক আছে।
সঙ্গীতের সাথে আত্মিক যোগসাধন করতে গেলে একটা ঘরানার কাছে, গুরুর কাছে যেতেই হবে… যিনি তোমাকে একটা ঠিক পথ দেখাবেন।

জি বাংলা সারেগামাপা সুত্রে এখন আপনার পরিচিতি অনেক বেশী।
সারেগামাপা এর মঞ্চ ও তার পুর্ববর্তী মঞ্চ কতটা পার্থক্য?
হঠাৎ সাফল্যে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রতিভা।কি বলবেন?
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। সারেগামাপা এর মঞ্চে যাওয়ার আগে যেসব অনুষ্ঠান করেছি তখন স্বপন স্যার এর কথাটাই মনে রেখে গেয়েছি। কি পেলাম কি পাবো ভাবিনি। শুধু গানে মন দিয়েছি।
নিঃসন্দেহে সারেগামাপা আমাকে অনেকটা সফলতা দিয়েছে।
সারেগামাপা একটা বড় দর্শক – শ্রোতার সামনে তুলে ধরেছে আমাদের। কিন্তু এর পরের কাজটা অনেকটা কঠিন।
এখন সফলতা পাওয়ার পর কিছু কিছু ছেলেমেয়েদের পা মাটিতে থাকছে না, তারা গানে মন দিচ্ছে না। আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে।
সফলতার সাথে দায়িত্ব আসে সফলতাকে বজায় রাখার। মাটিতে পা-টা শক্ত করে ধরে রাখতে হবে।
নইলে একটা সময়ের পর কেউ চিনতে পারবে না। নিজেকে, আর তুমি সঙ্গীতের যে ধারায় কাজ করছ সেই ধারাটাকে টিকিয়ে রাখার লড়াই কিন্তু একটা বড় লড়াই।
এখন অনেকেই সব রকমের গান করেন।
মঞ্চ আয়োজকরা অনেকেই চান যে আমরা এমন একজন শিল্পীকে আনব যিনি সব রকমের গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দেবেন।সস্তায় পুষ্টিকর ব্যপার হয়ে যায় আসলে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীরা নিজেরাই এটা করেন।
যেমন কেউ হিন্দি, বাংলা আধুনিক, সেমি ক্লাসিকাল, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন, নামার আগে দুটো লোকগান গেয়ে মঞ্চ থেকে নামছেন।
না, হাততালি পাওয়ার জন্য গান গাইলে হবে না।
নিজেকে একটা ধারায় আবদ্ধ করা, সেই ধারাকে টিকিয়ে রাখার লড়াইটা এই জন্যেই খুব কঠিন। যেটা অনেকেই পারেন না।
আজ মঞ্চ থাক বা কাল না থাক, যা কিছুই হয়ে যাক আমাকে আমার ধারা বজায় রাখতে হবে। এটা যারা পারেন, যারা এই মনোভাব নিয়ে চলেন তাঁদের সাধনা অনেক কঠিন।

বিখ্যাত হবার খিদেতেই কি অনেক প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে?
বিখ্যাত হওয়া সহজ। কিন্তু তারপর? আমি না থাকলেও মানুষ আমাকে মনে রাখবে।
এই খিদেটা থাকাই বড় কথা।
অল্প সময়ের জন্য নাম করে খড়ের গাদায় ছুঁচ হয়ে তো লাভ নেই। তার থেকে খড়ের গাদায় লাঠি হওয়া ভালো।
লোকগান তো ভাবসঙ্গীত…লোকগান বাস্তব জীবনের কথা বলে…
হ্যাঁ। প্রান্তিক মানুষদের খেটে খাওয়া জীবনের কথা, তাঁদের প্রতিনিয়িত লড়াই থেকে উঠে এসেছে লোকগানের কথা।
এই গানে আছে জীবনদর্শন…
আর একদিকে আছে বারো মাসে তেরো পার্বনের কথা।
আর একদিক ভাব সঙ্গীতের একটি অংশ বাউল বা মহাজনী পদ।
কিন্তু সব পর্যায়কে ছাপিয়ে গিয়ে লোকগান এর সাথে বাউলকে আমরা মিলিয়ে দিই।
সেটা নয়। বাউল একটা দর্শন। বাউল গান মানে লোকগান। কিন্তু লোকগান মানেই বাউল গান নয়।লোকগান শিল্পী মানেই বাউল শিল্পী নয় এটা বুঝতে হবে।
চারটে বাউল দর্শন ভিত্তিক গান গাইলেই লোকগান গাওয়া হয়ে যায় না।
লোকগানের বিভিন্ন ধারা আছে। যেমন চটকা, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, ঘাটু ইত্যাদি।
এই সব ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব একজন লোকসঙ্গীত শিল্পীরই।

লোকগানের বাস যেহেতু মুখে মুখে, তাই এখনও এমন অনেক গান আছে যা হয়ত আমরা শুনিনি বা জানিইনা।
বিভিন্ন আখরা, গুরুর সঙ্গ এর মাধ্যমে নতুন গান সংগ্রহ করার জন্য কি আপনারা কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
হ্যাঁ। দেখুন, শুধু একটা গান খুঁজে সেই গানকে বাঁচিয়ে রাখাই নয়, যিনি এতদিন এই গান কে আগলে রেখেছিলেন তাঁর নামটাও সকলের সামনে আসা উচিত।
এই কাজের জন্য ডিজিটাল মিডিয়াকে ভীষণ ভাবে ধন্যবাদ জানাতে হবে।
কিন্তু যারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে এই গান সংগ্রহ করছেন তাঁরা ডিজিটাল মিডিয়ায় সেই গানটি গেয়ে নিজের প্রচার করতেই ব্যস্ত।
যে মানুষটি এতদিন গানটা আগলে রেখেছিলেন তিনি যেহেতু প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত নন, তাই তিনি জানতেও পারলেন না কখন তাঁর গান আর তাঁর রইল না।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে ‘লোকবিতান’ নামে একটি সংগঠন করেছি। অনেক সংগ্রাহক শিল্পীকে সম্মান জানিয়েছি।
তবে এই কাজে লোকবল দরকার যা আমার কাছে আপাতত একটু কম।
আশাকরি আগামী দিনে আরও কাজ করতে পারব।
আপনি তো কেবলমাত্র লোকসঙ্গীত নিয়ে কাজ করছেন।
আগামী দিনে নতুন শিল্পীরা যারা লোকগান নিয়ে এগোতে চাইছেন তাঁরা কি গানের পাশাপাশি গানের প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে আপনার সাহায্য পাবে?
নিশ্চয়ই পাবেন। তবে,
একজন যে সবটা জানবেন এমন তো নয়, যতদিন আমার শ্বাস চলবে ততদিন আমার নিজেরই জানার ইচ্ছে থাকবে।
তবে হ্যাঁ। লোকগানের প্রেক্ষাপট নিয়ে যারা জানতে চান,তাঁরা সাধারণ মানুষের তুলনায় আমার কাছে এলে হয়ত তাঁদের একটু কম সময় লাগবে।
লোকগানের অনেক ধারা। যে যে বিষয় নিয়ে বেশী গবেষণা করেছে সে সেই বিসয়ে বেশী তথ্য দিতে পারবে।
দিদি আপনি তো নতুন লোকগান নিয়ে কাজ করছেন। মুক্তি পেয়েছে ‘বিনোদিনী রাই’… যা শ্রোতার মন ছুঁয়ে গেছে…
আগামী দিনে আবার কবে আপনার থেকে নতুন কাজ আমরা পাবো?
নিজের মৌলিক গান নিয়ে এখনও কিছু ভাবিনি। তবে প্লাবন কোরেশীর কথায় সুরে ঢাকার সাব্বির নাসির এঁর সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে মুক্তি পায় ‘বিনোদিনী রাই’।
গানটি গেয়ে আমার যেমন ভালো লেগেছে তেমনই শুনে মানুষের ভালো লেগেছে এটাই আমার পাওয়া।
আগামী দিনে আরও কিছু কাজ আসবে।

আগামী প্রজন্মকে কিছু বার্তা?
সব কিছুর উপরে গুরুর কৃপা থাকতে লাগে। খ্যাতি নয়, আমি চাই আমার যেন মাটিতে পা-টা থাকে।
নেতিবাচক কথায় ভেঙ্গে পরলে হবে না। নিজে কি চাই সেটা আগে নিজেকে ঠিক করতে হবে।
সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে, বাকি যা হবার এমনিই হবে।