Satkahon Fantastic Friday সাক্ষাৎকার বিভাগে আমরা তুলে ধরব আপনার কথা….
আমাদের গ্রুপটি জয়েন করে, পোস্ট করুন আপনার কাজের ইউটিউব,ফেসবুক লিঙ্ক, আঁকা বা অন্যান্য শিল্পকলা।
Mohanveena Soumalya Mukherjee | Friday Fantastic | Satkahon
Mohanveena Soumalya Mukherjee | Friday Fantastic | Satkahon
কবি বলেছেন, “বাহির পথে বিবাগী হিয়া কিসের খোঁজে গেলি? আয় রে ফিরে আয়”
সংগীত যদি অন্তরের কোন কোনাতেও থেকে থাকে তবে তা আপনিই ধরা দেবে বাহিরে। তাঁকে আটকে রাখা যাবে না অন্য কোন রপ রস গন্ধে বর্ণে।
সহস্র রকম ভাবে চেষ্টা করলেও সে মিলিত হবে তার পরমাত্মার সাধনে।
তেমনই গল্প মোহন বীণা বাদক সৌমাল্য মুখার্জীর।
জানালেন সাতকাহনের সাক্ষাৎকারে।
ছোটবেলায় বাবা- মায়ের ইচ্ছেয় তিনি শুরু করেছিলেন আঁকা শেখা। তখন তাঁর বয়স মাত্র তিন বছর।
কিন্তু ছবি আঁকার বদলে নিজের মুখেই রঙ মেখে বসে থাকতেন ছোট্ট সৌমাল্য।
আসলে সেই পথে যে পরমাত্মার সাথে মিলনের কথা ছিল না তাঁর।
ঠাকুমা বুঝলেন এই ছেলের দ্বারা আঁকা শেখা হবে না। দাদু বাজাতেন হাওয়াইয়ান গিটার। আঁকার থেকে বেশী দাদুর বাজনা শুনতে ভালবাসতেন তিনি। তাই সৌমাল্যর বাবাকে ঠাকুমা বললেন সৌমাল্যকে একটা ছোট গিটার এনে দিতে।
অবশেষে আঁকার পাঠ চুকে সৌমাল্যর হাতে এলো সেই হাওয়াইয়ান গিটার।
রেকর্ড প্লেয়ারে দাদু চালিয়ে দিলেন আয় তবে সহচরী।
বাড়ি শুদ্ধু লোককে চমকে দিয়ে প্রথমদিনই হুবহু সেই সুর তিনি বাজিয়ে ফেললেন গিটারে।
শুধু দাদুকে বাজাতে দেখেই তাঁর শেখা হয়ে গেছিল বেশ খানিকটা।
এ কথাতো আগেই বলেছি, অন্তর আত্মার সাথে একবার পরমাত্মা মিলিত হলে বিশ্ব প্রকৃতিতে কে কাকে বাধা দিতে পারে?
সেই জন্যেই তো কবি বলেছেন,
“সন্ধ্যা যদি তন্দ্রালীন মৌন অনাদরে, না যদি জ্বালে বাতি,
তবু তো আছে আঁধার কোণে ধ্যানের ধনগুলি,
একেলা বসি আপনমনে মুছিবি তার ধূলি,
গাঁথিবি তারে রতনহারে বুকেতে নিবি তুলি মধুর বেদনায়।“
সাত বছর বয়স থেকেই বাবা – মা – দাদু – ঠাকুমার উৎসাহে সংগীত যাত্রা শুরু হল তাঁর।
দাদু স্বর্গীয় হারাধন মুখোপাধ্যায়ের কাছে হাওয়াইয়ান গিটারে হাতে খড়ি সৌমাল্যর।
এরপর দশ বছর বয়স থেকে শেখা শুরু হল মোহনবীণা বাদক পণ্ডিত স্বপন মজুমদারের কাছে মোহনবীণা শেখা।
পরবর্তীতে তিনি বিশিষ্ট সেতার বাদক স্বর্গীয় পণ্ডিত সৌমিত্র লাহিড়ীর কাছে প্রশিক্ষন নিয়েছেন।
ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সম্মান অর্জন করেছেন সঙ্গীত বাদনে।
২০১২ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও প্রতিযোগিতায় ভারতবর্ষে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
এছাড়াও ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়েছেন তিনি।
প্রয়াগ সমিতি আয়োজিত ৫৬তম সমগ্র ভারত যন্ত্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেন সৌমাল্য।
মোহন বীণা প্রসঙ্গে সৌমাল্য জানান,
“ আর্চ টপ হাওয়াইয়ান গিটার, সেতার ও সন্তুরের মিশ্রনে তৈরি হয় ইন্ডিয়ান স্লাইট ক্লাসিকাল গিটার।
এই যন্ত্রে যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বাজানো যায় তা প্রথম পথ প্রদর্শন করেন পণ্ডিত ব্রিজভুষণ কাবরা।
প্রথমে এই যন্ত্রের তরফ ছিল না। পরবর্তীকালে এই যন্ত্রে তরফ লাগানোর পরীক্ষা নিরিক্ষা শুরু করেন স্বর্গীয় পণ্ডিত বরুন পাল, পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভাট, পণ্ডিত দেবাশিষ ভট্টাচার্য।
তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ উদ্ভাবনী শক্তি ও চিন্তাভাবনা অনুযায়ী এই যন্ত্রের পরিবর্তন এনেছেন ও উন্নতি সাধন করেছেন।
স্বর্গীয় পণ্ডিত বরুন পাল সৃষ্টি করলেন হংস বীণা।
পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভাট সৃষ্টি করলেন মোহনবীণা এবং পণ্ডিত দেবাশিষ ভট্টাচার্য সৃষ্টি করলেন চতুরঙ্গী।
পণ্ডিত বিশ্ব মোহন ভাট আবিষ্কৃত মোহন বীণা যন্ত্রের উদ্ভাবনটিকে বাস্তবিক রুপ দিয়েছিলেন স্বর্গীয় ভবসিন্ধু বিশ্বাস।”
সৌমাল্য এ প্রসঙ্গে জানান,
“আমি ওনাকে ভবসিন্ধু জেঠু বলতাম। তিনি আমাকে খুবই ভালবাসতেন।
জেঠু আমাকে আমার পছন্দ মত একটি যন্ত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। হলো নেক, সাইড ভরা এই যন্ত্রটিকে ঠিক মোহন বীণা বলা যায় না।
এখন আমার কাছে একাধিক মোহন বীণা থাকলেও আমি একাধিক অনুষ্ঠানে জেঠুর বানানো সেই যন্ত্রটি ব্যবহার করি।
আপাতত আমি ওটাকে ইন্ডিয়ান স্লাইড গিটারই বলি।
ভবিষ্যতে যন্ত্রটির একটি নামকরণ করার ইচ্ছে আছে।“
ICCR তালিকাভক্ত এবং আকাশবাণীর বি-হাই গ্রেড প্রাপ্ত শিল্পী সৌমাল্যকে
মোহন বীণা আবিষ্কারক পণ্ডিত বিশ্ব মোহন ভাট “মোহনবীণা বাদ্যযন্ত্রের যোগ্য উত্তরসূরি” বলে একটি শংসাপত্রে ভূষিত করেন।
সৌমাল্য বলেন,
“পণ্ডিতজীর কাছে সরাসরি না শিখলেও ওনার একটি ওয়ার্কশপে আমি যোগদান করি।
সেখানে তাঁকে আমার বাজনা শোনানোর সৌভাগ্য হয়। আমার বাজনা শুনে তিনি আমাকে এই শংসাপত্র দেন।
এটি আমার জীবনের অন্যতম পাওয়া।
এখনও তিনি আমাকে ভীষণই স্নেহ করেন।“
ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চ অনুষ্ঠান করেছেন তিনি।
ইতালি, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে তিনি কাজ করছেন।
সেগুলি সিডি আকারে শীঘ্রই মুক্তি পেতে চলেছে।
‘হলুদ চিঠি’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি নেপথ্য সঙ্গীতে জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার পায়।
সেই ছবির বেশ কিছু অংশে নেপথ্য সঙ্গীত করেন সৌমাল্য।
তুর্কি, ইজরায়েল, ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত থেকে সৌমাল্য কে মিলিয়ে মোট পাঁচ জন শিল্পীর মিলিত প্রয়াসে মুক্তি পেয়েছে ১৪২৭ নামে একটি মিউজিক অ্যালবাম।
সঙ্গীত নির্দেশক নীলাঞ্জন ঘোষের পরিচালনায় অন্তরা নন্দীর কণ্ঠে মুক্তি পেয়েছে চাঁদনি রাতে গানটি।
সেই গানে মোহন বীণা সঙ্গত করেছেন সৌমাল্য।
আগামী দিনে তাঁর বেশ কিছু কাজ আসতে চলেছে বিখ্যাত সঙ্গীত নির্দেশক জয় সরকারের নির্দেশনায়।
মোহন বীণা প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মিলনে তৈরি এমন একটি বাদ্যযন্ত্র যা এখনও উন্নয়নশীল।
যা নিয়ে এখনও নানারকম গবেষণা হচ্ছে। আগামী দিনে এই যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা আছে সৌমাল্যর।
যদিও তিনি কিন্তু ইতিহাসের ছাত্র। শ্রীরামপুর নগর উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি।
গানবাজনার পাশাপাশি পড়াশুনাতেও সমান দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছেন তিনি।
ডিজিটাল মাধ্যমে দেশ বিদেশের বিভিন্ন ছাত্র ছাত্রী তাঁর কাছে মোহন বীণা শিখছেন।
সব শেষে বললেন,
“যেকোনো কিছুই শিখতে গেলে একটু ধৈর্য ধরে শিখতে হবে। আর গুরুর প্রতি একটু সম্মান রাখতে হবে।
সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে শেখা শেষ বলে কিছু হয় না।যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন শিখব।
আমাদের সঙ্গীত জগতের মান অনেক নেমে গেছে। সস্তায় কিন্তু সঙ্গীত হয় না।
প্রত্যেক দিন রেওয়াজ করতে হবে, হাত কেটে যাবে, ঘাড়ে ব্যাথা হবে, কোমরে ব্যাথা হবে তবে কিছু শেখা যাবে।
পরিশ্রম করতেই হবে। পরিশ্রম ছাড়া কিছুই হয় না। আশ্চর্যের বিষয় আমাদের দেশের অনেক মানুষ সঙ্গীত পছন্দই করেন না।
অথচ বিদেশ থেকে কত শিক্ষার্থী তাঁদের দেশের সমস্ত বিলাসিতা ত্যাগ করে আমাদের দেশে এসে মাটির ঘরে দিনযাপন করছে সঙ্গীত চর্চা করবে বলে।
আমরা যদি নিজেরা আমাদের সঙ্গীতের মান রাখতে না পারি তাহলে সেটা আমাদেরই লজ্জা।“