MASAN HOLI মাসান হোলি | সুদীপ চক্রবর্তী | AMAR KOLOM | SATKAHON

MASAN HOLI মাসান হোলি | কলমে- সুদীপ চক্রবর্তী
সাতকাহন ‘আমার কলম‘ বিভাগে আপনার লেখা পাঠাতে চান?
WHATSAPP – 9038482776
MAIL– satkahonnews@gmail.com
১। যে কোন বিষয়ে অনধিক ৬০০ শব্দে লেখা পাঠাতে হবে।
২। লেখা হতে হবে বাংলায়।
৩। আপনার পরিচয় ও একটি ছবি অবশ্যই লেখার সাথে পাঠাতে হবে।
বসন্ত মানেই রঙ। আর রঙ মানেই যে উৎসবকে বোঝায় সেটা হল দোল। অর্থাৎ দোল মানে রঙের উৎসব।
বসন্তকে আবাহন, নতুন হাওয়া আর প্রেমের আনন্দে মেতে ওঠার সময়। আবিরে, পলাশে রাঙিয়ে দিয়ে গান গাওয়ার সময়।
কেবল বাংলা নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাবে দোল পূর্ণিমায় মেতে ওঠেন মানুষেরা।
বৃন্দাবন-মথুরার রাধাকৃষ্ণের আরাধনা, তাদের লীলাখেলাই হোক বা শান্তিনিকেতনের পলাশ, আবির আর রবীন্দ্রনাথ একেক জায়গায় দোল তার একেক রূপ নিয়ে হাজির হয়।
আবিরের জায়গায় অজান্তেই চলে আসে বাদুরে রঙ। ভাংয়ের নেশায় মেতে ওঠে গোটা ভারত।
দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে সেই আবিরের ঢেউ পৌঁছে যায় বিদেশেও।

এই রঙিন ছবিটি সরিয়ে একটু বাইরে আসা যাক। একটা বিশেষ উৎসবের দিকে পা বাড়াই আমরা।
আদতে সেটিও দোল উৎসবই। উল্লাস, উত্তেজনা, আনন্দ, গান-বাজনা, সঙ্গীত সবই রয়েছে।
কিন্তু এটি ঠিক রাধাকৃষ্ণের হোলি খেলা নয়। এখানে বিরাজ করেন এক ও একমাত্র দেবাদিদেব মহাদেব।
তাঁর ইচ্ছেতেই নাকি এখানে আনন্দে মেতে ওঠেন বাচ্চা থেকে বুড়ো। কিন্তু দোলের সুন্দর ছবিটা এখানে নেই।
বারানসীর এই উৎসবে আনন্দ, উল্লাস সবই আছে, নেই কেবল রঙ। এখানে দোলের রঙ ফ্যাকাসে।
বরং প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে ভয়ংকর, কুৎসিত (Terrific/atrocious beauty)! এখানে আবির নয়, মানুষের হাতে হাতে ঘোরে চিতাভস্ম! মানুষের অস্থিভস্ম !
সেই চিতাভস্ম, ছাই ধুলোই হাওয়ায় ওড়ে। সেটাই এখানকার আবির!
সাধু সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনীদের ভয়াল রূপ, মড়ার খুলি আর পুজোপাঠ – সব মিলিয়ে এক অন্য দোল উৎসবের সাক্ষী থাকে দেশ।
আর সেই উৎসবেই আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে বেনারস, বাঙালীর আপন কাশী। স্বাগত জানাবে MASAN HOLI। মাসান হোলিতে আবির নয়, হাওয়ায় ওড়ে শ্মশানের চিতাভস্থ!
শিবের প্রিয় এই দোল উৎসব, যে দোল উৎসব আজও ভারতের এক বিস্ময়!
CLICK TO JOIN: SATKAHON NEWS FACEBOOK GROUP

মাসান হোলি আসলে কি?
রাধা-কৃষ্ণের বদলে শিশু-পার্বতীকে কেন্দ্র করেই হোলির উদযাপন বেনারসে।
এটি সাধু-সন্ন্যাসী/সন্ন্যাসিনী, মূলত অঘোরীদের উৎসব।
কৃত্রিম বা কোন আয়ুর্বেদিক রঙ/আবির নয়, খোদ মণিকর্ণিকায় জ্বলতে থাকা মৃতদেহের চিতাভস্ম নিয়েই চলে হোলি খেলা।
বারানসীর আকাশে যেমন একদিকে উড়তে থাকে চিতাভস্মের ছাই ও ধুলো, তেমনি গোটা এলাকা গমগম করতে থাকে শিবভক্ত অঘোরীদের ‘ব্যোম ভোলে’ রব, ডম্বরু ধ্বনিতে।
গোটা আকাশ, বাতাস জুড়ে ম’ ম’ করতে থাকে গাঁজার গন্ধ। ভাঙের ফোয়ারা চলতে থাকে। সাধারনত আমরা যে দোল উৎসবের কথা জানি বা দেখি, তার থেকে বেশ খানিকটাই আলাদা এটি। প্রধানত হোলির পাঁচ দিন আগে, একাদশী তিথিতে এই উৎসব শুরু হয়।
এই বিশেষ তিথিকে কাশীর মানুষরা বলেন ‘রংভরি একাদশী’। কথায় বলে, বেনারস শহরটা শিবের ত্রিশূলের ওপর টিকে রয়েছে।
দেবাদিদেব মহাদেব শিবই এখানকার আত্মীয়, জামাই, প্রধান আরাধ্য ভগবান। কাশীর বাসিন্দাদের বিশ্বাস, রঙভরি একাদশীতে শিব এবং পার্বতী এক সঙ্গে মিলিত হন।
নিজের ভক্তদের সঙ্গে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। ভক্তদের মধ্যেই আনন্দে মেতে ওঠেন দুজনে।
আর তার পরদিন শিব চলে আসেন মাসানে। এখানে ভূত, প্রেত, আত্মা, মৃতদেহ, সাধু ও ভক্তদের সঙ্গে ফের একবার দোল খেলায় মেতে ওঠেন।
এই গোটা উৎসবটার নামই তাই মাসান হোলি বা মাসান দোল উৎসব। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই সুপ্রাচীন রীতি।
কিন্তু এমন আশ্চর্য্য হোলি উৎসবের কারন খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে শাস্ত্রে।
CLICK TO JOIN: SATKAHON NEWS FACEBOOK GROUP
হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী, মহাশিবরাত্রিতেই পার্বতীকে বিয়ে করে ছিলেন দেবাদিদেব মহাদেব।
তারপর স্ত্রী বাপের বাড়ীতে থাকার সপ্তাহ দুয়েক পর এই রঙভরি একাদশীতেই (ফাল্গুনী একাদশী) পার্বতীকে নিয়ে এই বারানসীতে আসেন মহাদেব।
তাই শিবভক্তদের কাছে এই উৎসব অত্যন্ত পবিত্র।
কথিত আছে, পার্বতীর পতিগৃহে আসার বিষয়ে শিবভক্তরা কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে অশান্তি শুরু করলে, স্বয়ং মহাদেব মণিকর্ণিকা ঘাটে এসে চিতাভস্ম মেখে ভক্তদের সঙ্গে হোলি উদযাপনে সামিল হন। সেখান থেকেই এই মাসান হোলি চলে আসছে।
অতীতে কেবল ভক্ত সন্ন্যাসীরাই এই অনুষ্ঠানেষ নিতে পারতেন।
কিন্তু দিনে দিনে এই হোলির জনপ্রিয়তা বাড়ার ফলে এখন সাধারন শিব ভক্তরাও অংশগ্রহণ করেন।

পুরাণ অনুযায়ী, কাশীর মণিকর্নিকাঘাটে মোক্ষ দান করেন ভগবান শিব। কাশী বিশ্বের একমাত্র শহর যেখানে, মৃত্যুকে শুভ হিসাবে দেখা হয়।
বলা হয় ‘রঙভরি একাদশী’র দিন দেবতা ও ভক্তদের সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেব হোলি খেলেন। সেখাতে ভূত, প্রেত, পিশাচরা হোলি খেলতে পারে না।
পরের দিন মণিকণিকার ঘাটে স্নানের সময় চিতাভস্মে হোলি খেলেন, চিতাভস্ম একে অপরকে মাখিয়ে দেন।
কথিত আছে ভগবান ভোলানাথ সবাইকে তাঁর মন্ত্রে দীক্ষিত করেন।
তাই শ্মশানের এই হোলিতে অংশগ্রহণ করাকে সৌভাগ্য বলে মনে করা হয়।
ডুগডুগির আওয়াজ, মন্ত্রপাঠ, হর হর মহাদেব ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হয়ে ওঠে।
CLICK TO JOIN: SATKAHON NEWS FACEBOOK GROUP
এই বিশেষ দিন, বেনারসের গলিতে গলিতে গেলে কেবল একটাই মন্ত্র, একটাই উৎসব।
মাসান হোলি উপলক্ষ্যে সমস্ত মানুষই পথে নেমে পড়েন। ঠিক কত বছরের পুরনো এই উৎসব?
সঠিক হিসেব নেই, তবে ভক্তদের বিশ্বাস, বেনারস শহর যবে তৈরী হয়েছে, তবে থেকেই এটি চলছে। হাজার হাজার বছর ট্র্যাডিশনে মেতে ওঠেন মানুষ।
তবে কেবল স্থানীয় মানুষরাই নন, দূরদুরান্ত থেকে ভয়াল দর্শন অঘোরী, নাগা সাধু, সন্ন্যাসিনীরা এই দোল খেলায় এসে যোগ দেন।
মূলত তারাই এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু।

‘রঙভরি একাদশী’র ওই বিশেষ শোভাযাত্রা শুরু হয় অঘোর পীঠ বাবা কেনারাম আশ্রম থেকে।
হাজার হাজার মানুষ শিব আর পার্বতীর মূর্তি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পরেন পথে। প্রায় প্রত্যেকেরই হাতে থাকে বিশাল বিশাল ডমরু।
সেই সমবেত আওয়াজে গমগম করে ওঠে গোটা বেনারস। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে আপনারও। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোতও নামতে পারে।
আর এনার্জী? একজনের থেকে আর একজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে সেই শক্তি।
আবির, সিঁদুর, ফুল এসব তো আছেই। তবে আসল উপকরণ এগুলো নয়।
CLICK TO JOIN: SATKAHON NEWS FACEBOOK GROUP
মাসান হোলির মূল জিনিসই হোলো ছাই। কিলো কিলো ছাই নিয়ে আসা হয় সবার জন্য।
তাও যে সে ছাই নয়, চিতাভস্ম! মানুষের অস্থিভস্ম! সে সবই গায়ে মুখে মেখে রাস্তায় নেমে পড়েন অঘোরী সাধু, সন্ন্যাসিনী থেকে সাধারন মানুষ।
সাধুদের টকটকে লাল চোখ, সিঁদুর আর লাল রক্ত-কটাক্ষের সঙ্গে থাকে নরমুন্ড। মানুষের মাথার খুলি দিয়ে তৈরী মালা পরে থাকেন তাঁরা।
সেটা নিয়েই নাচতে নাচতে সবাই হাজির হয় শ্মাশানে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনলেন।
শ্মশানই হল মাসান হোলির ‘বৃন্দাবনক্ষেত্র’।

মণিকর্ণিকা আর হরিশচন্দ্র বেনারসের এই দুইটি ঘাট ভারত বিখ্যাত। বলা হয়, এখানকার চিতা নাকি কখনও নেভেনা৷
সেই দুই শ্মশান ঘাটেই হাজির হন অঘোরী সাধু থেকে সাধারণ মানুষ। সে এক বিষম দৃশ্য। শ্মশানের মধ্যে মৃতদেহ আসছে, চিতা জ্বলছে, মানুষ পুড়ছে।
তারই মধ্যে ছাই চিতাভস্থ নিয়ে দোল খেলায় মেতে উঠেছে হাজার হাজার মানুষ।
মৃত্যুর পাশেই জীবনের আনন্দের উদ্যাপনের সহাবস্থান খুঁজে নিয়েছে বারানসী। এই অসম্ভব দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
একেক জনের একেক রকমের সজ্জা, একেক রকম আয়োজন। সারা গায়ে মানুষের অস্থি মেখে নিজেরাই “ভূত হয়ে ওঠেন কাশীবাসীরা। সেই সঙ্গে থাকে ভাং।
নেশায় শিবের আরাধনা, ডমরুর আওয়াজে শেষ হয় মাসান হোলি!
CLICK TO JOIN: SATKAHON NEWS FACEBOOK GROUP
বলা হয়, কাশীর এই মাসান হোলিই ভগবান শিবের সবচেয়ে আপন, প্রিয়তম উৎসব।
তাই তো তিনি নিজে ভক্তদের মাঝে উপস্থিত হন। এমনই বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে জেগে রয়েছে।
আজও গোটা ভারতের বিস্ময় এই বিশেষ দোল উৎসব। আজও দেশ বিদেশ থেকে অগুন্তি মানুষ আসেন কেবল এই উৎসব নিজের চোখে দেখার জন্য।
এখন অবশ্য কেবল ছাই থাকে না, সঙ্গে আবির, গোলাপের পাপড়ীও থাকে। তবে বেশিরভাগ অংশটাই থাকে সেই চিতাভষ্ম। তরুণ প্রজন্মও মাসান হোলিতে ব্যাপক ভাবে যোগ দেন।
সেখানে একটাই আরাধনা, একটাই মন্ত্র শিব৷ তিনিই তাঁদের বন্ধু, আত্মীয় আবার সহায়।
আর সেই গীতিই অদ্ভূত করেছে বেনারসের এই মাসান হোলিকে।
— তথ্যসূত্র আন্তরজাল