Dr Debalina Sinha Roy | Sunday Exclusive | Satkahon

Dr Debalina Sinha Roy

Dr Debalina Sinha Roy | Sunday Exclusive | Satkahon

গোলাপ ফুলের বাগানে সব ফুলের মাঝে একটা ছোট্ট বনফুলের গাছ যখন সাহস করে মাথা চারা দিয়ে ওঠে, মালী কিন্তু ফেলে দেয় না সেই বনফুলকে।

বরং সযত্নে তুলে এনে বাগানের অন্য এক কোনে তাকে রোপণ করে বলে, তুই তোর মত করে বড় হয়ে ওঠ।

কারণ তুই তোর মত করে সুন্দর।

সঙ্গীতশিল্পী ডঃ দেবলীনা সিংহ রায়ের জীবন গল্পও খানিক সেইরকম।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছত্রছায়ায় বড় হয়েও তাঁর মনে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছে লোকগান।

পরিবার তাঁকে বাধা দেয়নি এগোতে।

সব ধরণের গানে সাবলীল হলেও লোকগানই তাঁর প্রানের গান। তা নিয়েই করেছেন গবেষণা।

তা নিয়েই গান সেধেছেন ‘রুটস অ্যান্ড দেবলীনা’য়।

জানব তাঁর শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত গান যাত্রার কথা……… 

জীবন গল্পের শুরুতেই শুনব ছোটবেলার কথা…ছোটবেলা থেকেই কি গানের প্রতি ভালোবাসা?

একেবারেই তাই। আমার জন্ম আসানসোলে।

আমার ঠাকুরদাদা স্বর্গীয় মিহির মোহন সিংহ রায় ছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লার মানুষ।

তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী এবং গোয়ালিয়র ঘরানার সমরেন্দ্র সেনের কাছে।

বাবা স্বর্গীয় শ্রীকৃষ্ণ সিংহ রায়, ঠাকুরদার কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছেন ও পরবর্তীকালে কলকাতায় বিমান মুখোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নিয়েছেন নজরুলগীতি।

ফলে আমি বড় হয়েছি সম্পূর্ণ এক সাংগীতিক পরিবেশে। গান আমার রক্তে।

দাদু, বাবা দুজনেই সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন। ফলে বাড়িতে সবসময় ছাত্র ছাত্রীরা আসত। সেই শুনেই বড় হওয়া।

সাত বছর বয়সে আমার গানের হাতেখড়ি। আর বাবার কাছেই শেখা শুরু।

Dr Debalina Sinha Roy
বাবার সাথে

যেকোনো শিল্পীর কাছেই এই শেখার সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাবা ছাড়া আর কার কাছে শিখেছেন? শুধুই শাস্ত্রীয় সংগীত?

বাবার কাছেই আমার গান শেখা শুরু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দিয়ে।

ইংরাজী সাহিত্যে আমি স্নাতক হই আসানসোল থেকে।

এরপর আমি কলকাতা আসি উচ্চতর পড়াশুনার জন্য।

যতদিন আমি আসানসোলে ছিলাম ততদিন বাবার কাছেই আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, নজরুলগীতি ও নানা ধারার গান শিখেছি।

এরমধ্যে বলি, আসানসোলে অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (ABTA) এর একটি প্রতিযোগিতা হত।

স্কুলের শিক্ষিকারা জানতেন আমি গান করি, তাই নিজে থেকেই আমার নাম দিয়ে দিতেন।

সেইবার ABTA লোকসঙ্গীতের প্রতিযোগিতা আয়োজন করে।

দিদিরা আমার নাম দিয়ে দেন।

কিন্তু আমার পরিবারের সাথে লোকসঙ্গীতের সেই অর্থে কোন সম্পর্ক ছিল না কারণ বাবা বা দাদু কেউই লোকগান গাইতেন না।

আমি ক্যাসেট শুনে শুনে কিছু কিছু লোকগান শুনে শিখেছিলাম, বাবা একটু ঠিক করে দিয়েছিলেন।

এইভাবে আমি জেলা স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম। মা নিয়ে যেতেন সেইসব প্রতিযোগীতাস্থলে। 

কিন্তু যাতায়াতের সমস্যার জন্য আমি পরের স্তরের প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও যোগ দিতে পারিনি।

যদিও পরীক্ষা দিয়ে গান শেখা বা কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করা আমার বাবা পছন্দ করতেন না।

কারণ উনি মনে করতেন পরীক্ষা দিয়ে বা একটা প্রতিযোগিতা দিয়ে শেখার মান নির্ধারণ করা যায় না।

তাহলে সেই থেকেই লোকগানের সাথে আপনার পরিচয় হল? শুনব তারপরের ঘটনা…

হ্যাঁ। স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য আমি কলকাতায় আসি।

আমার ইচ্ছে ছিল আমি লোকগান নিয়ে পড়বো ও গবেষণা করবো।

এ প্রসঙ্গে বলি, আমার পরিবার কিন্তু আমাকে সবক্ষেত্রেই সহযোগিতা করেছেন।

আগেই বলেছি আমার পরিবারে কেউই লোকগান চর্চা করেন না।

কিন্তু আমার লোকগানের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে গেছিল তাই আমি পরবর্তী পড়াশুনা সেই বিষয়ে করতে চেয়েছি। বাবা বাধা দেননি কখনই।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে খেয়াল বিভাগে আমার নির্বাচন হয়।

খেয়ালের ক্লাস করতে আমার ভালো লাগে না আমি গিয়ে বসে থাকি লোকগানের ক্লাসে।

পরবর্তীকালে বিভাগ বদলে লোকগানে ফিরে আসি।

সেই সময় লোকগানে ন্যাশনাল স্কলারশিপের জন্য আমি প্রস্তুতি নিই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশিক্ষক শ্রী রঞ্জিত চক্রবর্তী স্যার এর কাছেই আমি তখন লোকগান শিখছি।

তাই ওনার  তত্ত্বাবধানেই ন্যাশনাল স্কলারশিপের পরীক্ষা দিই।

২০১১ সালে আমি স্কলারশিপ পাই।

শিক্ষার্থী জীবনের কোন স্মৃতি আজও মনে পড়ে?

একবার আসানসোলেই একটি প্রতিযোগিতা ছিল।সাধারণত সবাই যেমন গান গাওয়ার আগে একটু ভয়ে ভয়ে থাকে আমিও তাই ছিলাম।

কিন্তু আমার এক সহ প্রতিযোগী ছিল, যার মনে ভয় তো ছিলই না বরং সে একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী ছিল।

সে এমন কিছু আচরণ করছিল যা দেখে মনে হচ্ছিল হায় রে আমি তো কিছুই গাইতে পারব না। আমি তো কিছুই জানিনা।

আসানসোলে সেদিন ভীষণ গরম। প্রতিযোগিতার পরীক্ষা গৃহে আমার ডাক এলো।

আমি গাইলাম ‘আল্লাহ মেঘ দে,পানি দে’

মজার ঘটনা, আমি গানটা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই কাকতালীয় ভাবে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।

ঘটনাক্রমে সেই প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম হলাম।

সেদিন আমি একটা শিক্ষা পেলাম। যে, আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার, আছে সেটা জাহির না করাই ভালো। 

তুমি কি জানো, না জানো সেটা জাহির না করে, তুমি যদি তোমার কাজটায় নীরবে মন দাও, তাহলে জয় তোমারই হবে।

আজও সেই শিক্ষা আমাকে সাহস দেয়।

স্নাতকোত্তর শেষ হয়ে যাবার পর কি ভাবনা চিন্তা ছিল?

ইচ্ছে ছিল গবেষণা করব, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবো, এমন সময়  একদিন হঠাৎই অধ্যাপিকা ডঃ রীতা সাহার কাছে জানলাম ডঃ তপন রায় একটি লোকগানের ওয়র্কশপ করাবেন। রাধারমণ দত্ত ও পাঞ্জু শাহ্‌-র গান।

ওয়র্কশপ এ যোগ দিতে আমি বরাবরই খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু তপন স্যার এর সেই ওয়র্কশপ আমার জীবনে লোকগানের অর্থটাই বদলে দিল।

ওয়র্কশপ শেষ হয়ে যাবার পর আমরা ওনাকে অনুরোধ করলাম আমরা ওনার কাছে গান শিখতে চাই।

তখনও স্যার কাউকে গান শেখাতেন না।

অনেক অনুরোধ করার পর উনি শেখাতে রাজি হলেন।

লোকগানের প্রেক্ষাপটটাই আমার কাছে বদলে গেলো, এর সাথে যে কত প্রতিবাদ , কত লড়াই জড়িয়ে আছে আমি নতুন করে জানলাম।

Dr Debalina Sinha Roy
সঙ্গে বাবা ও শিক্ষাগুরু ডঃ তপন রায়

কিন্তু আমার তখন সেই অর্থ সামর্থ্য ছিল না যে আমি রঞ্জিত স্যার এবং তপন স্যার দুজনের কাছেই শিখব।

তপন স্যারকে আমার বন্ধুরা এই কথা বলতে স্যার আমাকে ফোন করে খুব বকলেন।

বললেন, একদিন যখন উপার্জন করবে তখন আমাকে টাকা দেবে।

পয়সার অভাবে তুমি গান শিখবে না তা কখনই হয় না।

আজও কিন্তু আমি ওনার ছাত্রী।

ওনার থেকে সেদিন যে শিক্ষা পেয়েছি আজ আমি আমার জীবনে আমার ছাত্র ছাত্রীদের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করি।

এই প্রসঙ্গে আমি একটাই কথা বলব আমার বাবা আমার শিক্ষাগুরু এবং আমার গুরু আমার পিতৃসম।

পেশাগত শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ কবে করলেন?

স্নাতক স্তর থেকে আমি পেশাগত শিল্পী হিসেবে বহু মঞ্চ অনুষ্ঠান করেছি।

আমার সংগঠন আসানসোল উড়ান। সেই সংস্থার সাথে আমি বলা যায় প্রথম থেকেই যুক্ত।

সেটি মূলত একটি স্টাডি সার্কেল হলেও উড়ানের  হয়ে আমরা বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি।

এবং আমার একক অনুষ্ঠানও সেই সময় থেকেই শুরু।

একজন শিল্পী হওয়ার পাশাপাশি আপনি একজন শিক্ষিকা। আপনার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান এর নাম কি?

না । আমি, আমার বাবা বা দাদু কারুরই সেই অর্থে কোন প্রতিষ্ঠান নেই। ওনারা প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রীকেই হাতে ধরে গান শেখাতেন।

ওনারা একক ভাবে গান শেখানোয় বিশ্বাসী ছিলেন।

আগে গান শেখালেও এখন আমি গান শেখাই না।

এখন আমি NET এর ছাত্র ছাত্রীদের পড়াই।

সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ইন্সটিটিউট ফর নেট স্টাডিস।

কি কি কাজ করছেন গান নিয়ে?

মঞ্চ ও টিভির অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বেশ কিছু নিজের গান রেকর্ড করেছি।

এছাড়াও কিছু সিনেমায় যেমন বাস্তুহারা, ডিকশনারি, লক্ষীছেলে ইত্যাদি ও সিরিয়ালে আমি প্লে ব্যাক করেছি।

বর্তমানে আমার লোকগানের দল ‘রুটস অ্যান্ড দেবলীনা’ নিয়ে কাজ করছি।

কিছুদিন আগেই আমাদের একটি ডিজিটাল অনুষ্ঠান হল, যা কয়েকশো মানুষ শুনেছেন, যেটা আমার কাছে বিশাল বড় পাওয়া।

লোকগানের মূল বিষয় হল আঞ্চলিকতা। প্রত্যেকটি অঞ্চলের আলাদা আলাদা গানের ধরণ, উচ্চারণ ও বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ আছে।

সেগুলো বজায় রেখে গাওয়াটাই আসল গান গাওয়া।

তার জন্যে সঠিক ভাবে শিখে গাইতে হবে।

লোকগান বর্তমান দিনে অনেকের কাছেই লোক নাচাবার গান হয়ে উঠেছে।

কিন্তু আসলে লোকগান খুবই গবেষণামূলক ও বিষয়ভিত্তিক।

হেমাঙ্গ বিশ্বাস এর গানে লোকসংগীতের ভূমিকা বিষয়টি নিয়ে আমি  ডঃ রীতা সাহার তত্ত্বাবধানে  গবেষণা করেছি।

২০১৯ এ আমি ডক্টরেট উপাধি পাই।

এই বিষয়ের ওপর একটি বই খুব শীঘ্রই প্রকাশ পাবে তাঁর সাথে সাথে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণা মূলক লেখালেখি চলছে।

লোকগান নিয়ে গবেষণা করলেও আপনার কণ্ঠে আমরা বাংলা মৌলিক গান ও অন্যান্য ধারার গানও শুনেছি…

হ্যাঁ। আমি লোকগান নিয়ে গবেষণা করলেও প্লে ব্যাকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধারার গান গেয়েছি।

সব ধরণের গান গাইতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কিন্তু একক অনুষ্ঠানে আমি লোকগান গাইতেই পছন্দ করি।

আমার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ‘রুটস অ্যান্ড দেবলীনা’ লোকগান নিয়েই কাজ করছে আর করবে।

আগামী দিনে কি কি পরিকল্পনা রয়েছে?

বাবাকে হারিয়েছি ২০২০ সালে। যেহেতু বাবার কাছে ছোট থেকে নজরুলগীতি শিখেছি সেহেতু আগামী দিনে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নজরুলগীতি নিয়ে কিছু কাজ করার ইচ্ছে আছে।

নিজের একক অনুষ্ঠান আর লোকগান নিয়ে অন্য ধারার কিছু করার ইচ্ছে আছে।

 লোকসঙ্গীত আমাদের সম্পদ। তবে সহজ সুর বলেই এই গানকে সহজ ভাবলে হবে না।

এই গানের উপস্থাপনাটা সঠিক ভাবে করতে গেলে শিখতে হবে যত্ন নিয়ে ।

যিনি এই লোকগান নিয়ে জীবনের ২০-২৫ বছর কাটিয়েছেন তাঁর তত্ত্বাবধানে লোকগান রেকর্ড করুন।

এমন করে আমাদের সম্পদ নষ্ট করবেন না।

না শিখে , না বুঝে , না জেনে গাইলে এই গান ফিউশন নয়, কনফিউশন হয়ে যাবে।

 COPYRIGHT © SATKAHON

8 thoughts on “Dr Debalina Sinha Roy | Sunday Exclusive | Satkahon”

  1. I am a student of Dr. Debalina Singha Roy mam…. Mam is a very good soul person ♥️🙇🏽‍♀️🎼🙏🌹

  2. Anujit roy chowdhury

    Ei projonmer onnyotomo sera Lok songit shilpi ebong gobeshika Dr. Deblina sinha roy er jiboni porlam, dekhlam, shunlam. Solpo porisore oti chomottkar kaj korechen Suranjana banerjee

  3. চন্দ্রানী বসু।

    খুব ভালো লাগল। অনেক অনেক অভিনন্দন জানাই তোমাদের।।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *