Arpita Das – Singer | একটি মেয়ের যুদ্ধকাহিনী | Satkahon Interview

Arpita Das – Singer
প্রযুক্তি, শিক্ষা, সাজসজ্জা যতই বদলাক না কেন, মানুষের মানসিকতা বদলাতে সময় লাগবে বোধহয় আরও অনেক দিন।
দুর্গাপুরের মেয়ে অর্পিতার সাক্ষাৎকারে সেইরকমই কিছু কথা উঠে এলো…
শিল্পী জীবন টিকিয়ে রাখা, সাফল্যের জন্যে লড়াই, পরিবারের পাশে ঢাল হয়ে থাকতে চাওয়া এক মেয়ের কাহিনী।
আসুন জেনে নিই…..
কেমন ছিল ছোটবেলা?
আমার জন্ম দুর্গাপুরে। মা-বাবার ইচ্ছে ছিল আমাকে গান শেখাবেন। মা গান করতেন বাবা তবলা সঙ্গত করতেন।
পেশাগত ভাবে না হলেও দুজনেরই যেমন হয় বাঙালী পরিবারে গানের প্রতি একটা টান ছিল।
এমনকি আমি ছোটবেলাতেও দেখেছি মাকে গান শিখতে।
আমার যখন চার বয়স বয়স শুনেছি মায়ের মুখে গান শুনতে শুনতে আমি গেয়ে উঠেছিলাম “আমার গানের মালা আমি করব কারে দান”
তখন সরগম শিখিনি। বরং নাচ শিখতাম।
আমার গান শুনে মা-বাবার মনে হল আমার গলায় সুর আছে তাই মায়ের সংগীত শিক্ষক স্বর্গীয় পরিমল সরকার মহাশয়ের কাছে আমার প্রশিক্ষন শুরু হয়।
আপনি তাহলে গানের পাশপাশি নাচ শিখেছেন?
সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমি কত্থক ও পরবর্তীকালে Contemporary শিখেছি। দীর্ঘদিন।
নাচের প্রতি এখনও আমার ভালোলাগা আছে।
সেই সময় ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা ছিল না একটাই আনন্দ ছিল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া আর পুরস্কার পাওয়া।
তারপর প্রথাগত সংগীতশিক্ষা কার কার কাছে? মূলত কোন ধারায় গান শিখেছেন?
প্রথমে তো আমার গুরু স্বর্গীয় পরিমল বিশ্বাস মহাশয়ের কাছে আমি শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছি। এরপর দুর্গাপুরেই শ্রী তপন দের কাছে আমি নজরুলগীতি ও আধুনিক গান শিখি।
তখন থেকেই গানের প্রতি আমার মনে গানের প্রতি ভালোবাসা শুরু হয়।
এরপর কলকাতায় আসি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি শাস্ত্রীয় সংগীত (Vocal Music) নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশুনা করি। সেই সময় আমি শ্রী শুভ্রকান্তি চট্টোপাধ্যায় ও শ্রীমতী রাজ্যশ্রী ঘোষের কাছে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করি।
২০১৬ সালের পর আমি লোকগান শিখতে শুরু করি শ্রী অভিজিৎ বসুর তত্ত্বাবধানে। এখন আমি শ্রী অভিজিৎ বসু (লোকগান) ও শ্রী উদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের (আধুনিক ও নজরুলগীতি) কাছে সঙ্গীতে প্রশিক্ষন নিচ্ছি।
সংগীত শিল্পী হয়ে ওঠার ইচ্ছে তাহলে ছোট থেকেই?
না আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলাম। ভেবেছিলাম ডাক্তার হবো। উচ্চমাধ্যমিকের পর ইচ্ছে হল গান নিয়ে পরব।
আসলে বাবার খুব ইচ্ছে ছিল সংস্কৃতি জগতে কিছু করার কারণ বাবা নাটক-থিয়েটর করতেন। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছেটা বাবা আমার মধ্যে দিয়ে পূরণ করতে চেয়েছিলেন।
প্লে ব্যাক করব গান গাইব এই স্বপ্ন নিয়ে তাই আমার কলকাতায় আসা।

জীবনের উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতা কি কি?
দুর্গাপুরে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমি অগুন্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। কখনো নাচে প্রথম গানে দ্বিতীয় তো আমার কখনো গানে প্রথম নাচে দ্বিতীয় এই ভাবেই কেটেছে।
নবম শ্রেনীতে পড়া কালীন নিখিল বঙ্গ সংগীত আকাদেমির প্রতিযোগিতায় আমি দ্বিতীয় হই ও রৌপ্য পদক পাই।
কলকাতা আসার পর আমি রাজ্য সংগীত আকাদেমির প্রতিযোগিতায় অংশ নিই।
প্রথম বার আমি কোন স্থান পাইনি। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিই নিই। পর পর আর তিন বছর আমি অংশ নিই এবং পর পর যথাক্রমে তৃতীয়, দ্বিতীয় এবং অবশেষে প্রথম হই।
এছাড়াও রবীন্দ্রভারতীতে পড়াকালীন আমি All India Merrit Test এ নজরুলগীতি ও বাংলা গানে দ্বিতীয় হই।
তখন থেকেই বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান আমি অংশগ্রহন করার সুযোগ পাই।

একাধিক টিভি চ্যানেলে আপনি অনুষ্ঠান করেছেন…
হ্যাঁ, তারা মিউজিকের Take A Break, দূরদরশনে ‘সকাল সকাল’, আজ সকালের আমন্ত্রন, রূপসী বাংলা, CTVN এর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি একাধিকবার অংশগ্রহণ করেছি।
২০১৯ এ আকাশ আট এর Suparstar প্রতিযোগিতায় আমি বিজয়ী হই এবং Good morning আকাশ এর অনুষ্ঠান থেকে আমন্ত্রন পাই।

প্লে ব্যাক বা নতুন বাংলা গান নিয়ে কোন কাজ?
বেশ কিছু সিনেমায়, স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবিতে, বিজ্ঞাপনে আমি প্লে ব্যাক করেছি আর করছিও। আগামী দিনে কিছু কাজ আসছে।
১২ই নভেম্বর আমার একটি নতুন বাংলা মৌলিক গান আসতে চলেছে যার নাম “স্বপ্ন সাজিয়ে”
আশাকরি সবাইকে পাশে পাবো।

শিল্পী হবার লড়াইটা কেমন ছিল? কাকে পাশে পেয়েছেন কাকে পাশে পাননি?
পড়াশুনা শেষ করে গুরু অভিজিৎ বসুর কাছে শেখা শুরু হবার পর উনি আমাকে অনেক যত্ন করে লোকগান শিখিয়েছেন।
আমাকে পথ দেখিয়েছেন কিভাবে এগোতে হবে। কিভাবে আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করব সব কিছুতে উনি আমাকে সাহায্য করেছেন।
লোকগানের সাথে দূরদূরান্তে আমার কোন সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু উনি আমাকে এমন করেই তৈরি করেছেন যে মানুষ বর্তমানে আমাকে লোকগানের শিল্পী হিসেবেই বেশী চেনেন।
নচি দার একটি অনুষ্ঠানে আমার ওনার সাথে পরিচয় হয়। উনি আমার গান শোনেন। আমি গেয়েছিলাম “সঘন মগন”।
উনি একটাই কথা বলেছিলেন “পারফেক্ট আছে”। পরবর্তীকালে একই মঞ্চে ওনার সাথে উনি আমাকে গাইবার সুযোগ দেন।
এটা আমার একটা সারাজীবনের পাওয়া।
আর পাশে পাইনি তো অনেক কেই।
যেমন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী অনেকেই বলতেন গান গাই আর যাই করি টিভিতে অনুষ্ঠান করার মত যোগ্যতা আমার নেই।
আমার চ্যালেঞ্জ ছিল আমি করে দেখাবই।
বাবা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ২০১৬তে সেটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারে আয় কর্তা ছিলেন বাবাই।
আমার কলকাতায় থাকা থেকে সব টুকুই বাবা দেখতেন। তাই কোম্পানি বন্ধ হবার পর আমরা একটা খুব খারাপ সময়ে সম্মুখীন হই।
অনেকে বলতে থাকেন আমাকে যেন বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। সেটা হয়ত করা যেত কিন্তু দুর্গাপুর ফিরে গেলে আমার গানটা শেষ হয়ে যেত।
তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজকদের অনুরোধ করেছি একটা অনুষ্ঠান পাওয়ার জন্যে। পেয়েওছি।
নিজের খরচা চালাবার জন্য়ে, পরিবারের জন্যে অনেকটা লড়াই করেছি। সেটাতে অনেকে বলেছে “রাত বিরেতে গান গেয়ে বাড়ি ফিরছিস এটা ভালো মেয়ের লক্ষন নয়।“
আমার অনেক সম্পর্ক ভেঙে গেছে এই কারণে যে আমি লড়াই করে আমার গান কে বাঁচিয়ে রেখেছি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছি।
সমাজ, শ্রোতার উদ্দ্যেশে কি বার্তা দেবেন?
গান গেয়ে আর কি হবে? মেয়ে বড় হয়ে গেছে বিয়ে দিয়ে দাও। এই চিন্তা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসুন।
একটা মেয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারে একটা ছেলের মত।
রাতে অনুষ্ঠান থাকলেই বাজে মেয়ে হয় না।
আগামী দিনে আমার ইউটিউব চ্যানেল থেকে বেশ কিছু কাজ আসছে।
আশাকরি আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের পাশে পাবো।