শিকার – মানুষরূপী পশুর শিকার করবে কে? | Bhumisuto | Satkahon Review
শিকার – মানুষরূপী পশুর শিকার করবে কে?
সমাজ আমাদের তৈরি করে, আবার সমাজই আমাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে।
এই পার্থক্য মানুষকে মানুষের থেকে করে তোলে ভিন্ন, যে কারনেই জন্ম নেয় ধনী গরীবের বিভেদ, জাতিভেদ, উঁচুনিচু বিচার…
সমাজের এই ক্রূঢ় দিকই চিরকাল যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে…
ঠিক সেই রকম সমাজের এক ঘৃণ্য রুপ ফুটে উঠেছে ভূমিসুত থিয়েটার এর কর্ণধার, বিশিষ্ট নাট্যপরিচালক স্বপ্নদীপ সেনগুপ্ত পরিচালিত ‘শিকার’ নাটকে।
কাহিনীর উপস্থাপনা, চিত্রনাট্যের বুনিয়াদ একের পর এক যেভাবে সাজিয়েছেন স্বপ্নদীপ তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।
গত ২০শে ডিসেম্বর গঙ্গা যমুনা নাট্যোৎসবে তপন থিয়েটারে ভূমিসুত নাট্যদলের অভিনয়ে দর্শকের উচ্ছাস সেই কথাই বলে গেলো।
সহজ সরল সাঁওতাল আদিবাসী ঘিনুয়া।ছোট থেকে ক্ষেতের ফসলকে পশুদের হাত থেকে বাঁচানোই তার কাজ।
ডেপুটি কমিশনারের নির্দেশে সে পশু শিকার করে আনে এবং বদলে পায় পুরস্কারের অর্থ। একদিন শিকারের বদলে সে দাবী করে বেশী টাকা।
ডেপুটি অবাক হন, জানতে চান কেন? তখন সে তার ঝুলি থেকে বের করে গ্রামের জমিদারের কাটা মাথা।
পশুরা মানুষের ক্ষতি করে, কিন্তু যে মানুষ অন্য মানুষের ক্ষতি করে, অত্যাচার করে, নারীর উপর করে নির্যাতন সে তো পশুর থেকেও ভয়ঙ্কর। তাই পশুর চাইতে তার কাটা মাথার দাম হওয়া উচিত বেশী। তাই কেন বেশী অর্থ দাবী করবে না সে?
ঘিনুয়ার সহজ সরল প্রশ্নের উত্তরে ভয় পেয়ে যান সমস্ত অন্যায়ের গোপন পৃষ্ঠপোষক ডেপুটি। ভুল বুঝিয়ে ঘিনুয়াকে বন্দী করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ফাঁসি হয় তার। চাপা আগুন জ্বলতে থাকে সাঁওতালদের মধ্যে।
পরের গল্প রোমহর্ষক। শিরায় শিরায় সেই গল্পের রস আস্বাদন করতে হলে এই নাটক দেখতে হবে সরাসরি। চোখ রাখতে হবে ভূমিসুতর ফেসবুক পেজটিতে।
কোলাঘাট অঞ্চলের থিয়েটার প্রেমী মানুষজন এই নাটক দেখতে পাবেন আগামী ২২শে জানুয়ারি সরাসরি।
ঘিনুয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন কাজল শম্ভু, তবে কোন কোন উপস্থাপনায় এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনির্বাণ সিকদার।
ঘিনুয়ার স্ত্রী সুমির চরিত্রে অভিনয় করেছেন সমাদৃতা পাল সেনগুপ্ত। ছোট ঘিনুয়ার চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছে শিশু শিল্পী সুরঞ্জন মার্জিত।
মাত্র নয় বছর বয়সে শিশু শিল্পী সুরঞ্জনের অভিনয় দেখার মত। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেরা শিশু শিল্পীর পুরস্কারও পেয়েছে সে।
প্রত্যেকের অভিনয়ে ছিল অসাধারণত্ব।
তবে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন, চাপরাশির ভুমিকায় জ্যোতির্ময় ব্যানার্জী, সিপাহির ভুমিকায় ইন্দ্রজিত দে, ডেপুটি কমিশনারের ভুমিকায় পুর্নেন্দু ধর, ফাঁসুড়ের ভুমিকায় সৌরভ ধর, বিচারকের ভুমিকায় অভিজিৎ গুহ, উকিলের ভুমিকায় শমীন্দ্র কৃষ্ণ দেব।
এছাড়াও একত্রিত অভিনয়ে ও নৃত্য পরিবেশনে ছিলেন অজয় প্রধান, শুভজিত সাহা, পারমিতা বিশ্বাস, দেবলিনা ব্যানার্জী, সোফিয়া শর।
মঞ্চসজ্যায় নজির রেখেছেন অভিনেত্রী সমাদ্রিতা পাল সেনগুপ্ত ।এমনকি এই নাটকের আবহও তাঁরই পরিকল্পিত।
আবহ সঙ্গীতে ঢোল ও মাদলে কৌশিক ওঝা, অনির্বাণ সিকদার, বাঁশিতে শোভন দেব মণ্ডল, দোতারাতে বিপুল রায় তাঁদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
আলোক চিত্রশিল্পী ছিলেন সৈকত মান্না।
সংস্কৃতির হাত ধরেই মানুষের বিচার ক্ষমতা তৈরি হয়।কারণ সংস্কৃতি বাস্তবের আয়না। যে আয়নায় আমরা আমাদেরই কর্মের প্রতিফলন দেখতে পাই।
পরিচালনাতেই শুধু নয়, স্বপ্নদীপের দক্ষতা ফুটে উঠেছে তাঁর চিন্তাভাবনায়।
ভগবতী পানিগ্রাহি রচিত উপন্যাস অবলম্বনে জহর দাশগুপ্তের লেখা নাটক ‘শিকার’-এ তাই তাঁর চিন্তায় ব্রিটিশ শাসনের পরিবর্তে উঠে এসেছে বর্তমান সমাজের প্রশাসকদের অত্যাচার, ভেদাভেদ, অবমাননা ও প্রতিবাদ।
জীবনের উপলব্ধি থেকে ধ্বনিত হয়েছে প্রত্যেকের অভিনয়, আর জীবন দর্শনই দর্শকের কাছে এই নাটককে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলেছে।