চা-কথা ২ | সুদীপ চক্রবর্তী | আমার কলম | Satkahon

চা-কথা ২ | কলমে – সুদীপ চক্রবর্তী

রীতিঃ

…… ইরান দেশে এনি টাইম ইজ টী টাইম। চা ওদেশে জাতীয় মর্যাদা পেয়েছে।

চা পাতার সঙ্গে কখনও সুগন্ধী ফুল বা গাছ গাছড়া মিশিয়ে মুখবন্ধ ক্যানেস্তারায় রেখে কিছু দিন পরে তা ব্যবহার করে।

বাড়ির মধ্যে বয়জ্যেষ্ঠর উপর ভার থাকে চা তৈরীর। এই উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট কম্বলের আসনে বসে সে সামোন্ডার থেকে রুপোর বাটীতে লিকার ঢেলে লেবু ও চিনি সহযোগে চা পরিবেশন করে।

বিনা দুধে কালো রঙের কড়া লিকার ইরাকিদের প্রিয়।

ওরা ছোট ছোট গ্লাসে চা পান করে, তাকে বলে ইস্তিকান।

ইন্দোনেশিয়া হল চাফসলের জায়গা। ওরা সবুজ চায়ে সুগন্ধী ফুল মিশিয়ে রাখে।

গৃহ স্বামীনীর উপস্থিতিতে নক্সাকাটা রূপোর বাটীতে লিকার পান করা ওদের পছন্দ।

ইতালিতে দ্বি-প্রাহরিক চা পরিবেশন করা সামাজিক নিয়ম।

চিনি-সুধ যা লেবু সহযোগে গ ও তার সঙ্গে ওয়াইনের গন্ধ যুক্ত স্বাদু পেস্ট্রী পরিবেশন করা হয়।

রান্নার পাচকের মত মরক্কোর অভিজাত পরিবারে চা করার জন্য লোক নিযুক্ত করা হয়।

সেই লোক পিতলের বা রুপোর কেটলীতে বিলিতি মতে চা করে। আর গৃহস্বামী তাতে নিজ হাতে চিনি বা পুদিনা মিশিয়ে দেয়।

চায়ের সঙ্গে সবসময় আখরোট বাদাম পরিবেশন করা নিয়ম। আর অতিথির কর্তব্য হল অন্তত তিন গ্লাস চা খাওয়া। মরক্কোবাসীর সবুজ চা ভালোবাসে।

ঠিক তার উল্টো নিয়ম চীন দেশে। সেখানে দ্বিতীয়বার চা গ্রহণের অনুরোধ মানে তাকে বিদায় নিতে বলা।

হাতলবিহীন বাটীতে সুগন্ধী চাপাতা রেখে, তার উপর না ফোটা গরম জল ঢেলে চীনারা তারিয়ে তারিয়ে তাই পান করে।

তাতে না থাকে দুধ, না থাকে চিনি।

জাপানীরা চা কে শ্রদ্ধা করে, তাই সকালে চা করে প্রথমে স্বর্গীয় পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে তা নিবেদন করে।

তারপর বাড়ীর বয়জেষ্ঠ্যকে দিয়ে অন্যরা চা পান শুরু করে। চিনি, দুধ ছাড়া সবুজ চা ওদের পছন্দ।

শ্রীলংকায় চা জাতীয় পানীয় হিসাবে গণ্য হয়। অতিথিকে ওরা চা দিয়ে আপ্যায়ন করে।

গ্রামাঞ্চলে বাড়ীর সামনে কলার কাঁদি ঝোলানো দেখলে বুঝতে হবে ভেতরে চায়ের দোকান আছে।

সিংহলীরা পেতলের বাটীতে ঢালা-উপুড় করে চা খায় যে কায়দায় দক্ষিণভারতীয়রা কফি খায়।

রাশিয়ায় চা তৈরী হয় ভিন্ন নিয়মে। সমভারে জল ফোটে আর তার মুখে একটা পাত্রে কড়া লিকার থাকে।

রুপোর আধারে বসানো গ্লাসে কড়া লিকার ঢেলে তাতে ফুটণ্ড জল মিশিয়ে লেবু বা এক চামচ জ্যাম গুলে খায়। কেউ কেউ চিনি দাঁতে চেপে চায়ে চুমুক দেয়।

তুরস্কবাসীদের চা করার পদ্ধতিতে নতুনত্ব আছে। আগুনের উপর একটি পাত্রে জল ও তার উপরের পাত্রে চা পাতা রেখে তাতে ফুটন্ত জল ঢেলে আধঘণ্টা ভেজানো হয়।

অতিথির সামনে চা তৈরী ওদেশে নীতি বিরুদ্ধ। চা খাওয়া শেষে চামচটাকে গ্লাসের উপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে দিতে হয়।

সিরিয়াবাসীদের ধারনা দূরকে নিকটে আনতে চায়ের জুড়ি নেই। তাই ওদেশে বড় হলে বা কোন চত্বরে চায়ের দোকান দেওয়া হয়-ওরা বলে ‘চায়খানা’।

সেখানে সবাই আসে, বসে, গল্প করে, দাবা খেলে কেউ ধূমপান করে কিন্তু সবাই হৈচৈ করে চা পান করে।

ওখানে রাশিয়ান প্রথায় চা করা হয়।

চায়ের প্রকার ভেদ :

প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া অনুসারে চা বিভিন্ন প্রকারের হয়।

সাদা চা, কালো চা বা ব্ল্যাক টি, সবুজ চা বা গ্রীন টী, ওলং চা, পুষের চা ইত্যাদি।

প্রায় সবরকম চা-ই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থেকে তৈরী হলেও বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুতের কারণে এক এক ধরনের চা এক এক রকমের স্বাদ যুক্ত

হয়। পুষের চা এক ধরনের গাঁজনোত্তর চা যা অনেক ক্ষেত্রে ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

ভেষজ চা হল এক ধরনের নিষিক্ত পাতা, ফুল, লতা ও উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ যাতে কোন ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নেই।

দক্ষিণা আফ্রিকার রুইবস গাছ থেকে তৈরী চা এ কোন ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নেই।

কালো চা বা ব্ল্যাক টি

এটি ওলোঙ, সবুজ বা সাদা চায়ের তুলনায় অধিক জারিত (অক্সিডাইজ) করা হয়।

ব্ল্যাক টী স্বল্প জারিত চায়ের তুলনায় সাধারণত অধিক গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে।

ওলোঙ চা :

‘ওলোঙ’ কথাটির অর্থ হল কালো ড্রাগন, এই কারণে ওলোঙের আর একটি নাম কালোনাগ চা।

এতে চা পাতার অক্সিডেশন বা ফার্মেন্টেশনের উপর চা এর রঙ ও গন্ধের পরিবর্তন হয়। গ্রীন টী একেবারেই ফার্মেন্ট করা হয় না।

কিন্তু এই কালো ড্রাগনকে মাঝামাঝি অক্সিডাইজ বা ফার্মেন্ট করা হয়। এতে চা পাতার ফার্মেন্টেশনের রঙ পরিবর্তনের আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তাই গ্রীন টী এর থেকে কড়া স্বাদ যুক্ত হলেও ব্ল্যাক টী এর চাইতে কম ক্যাফেইন থাকে। মূলত চা টি মেদ কমাতে সাহায্য করে।

মসলা চা

সাধারণত সুগন্ধিযুক্ত

এক প্রকার উষ্ণ পানীয়কে বোঝায়। কালো চা পাতার সাথে এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা, আদা ইত্যাদিবিভিন্ন প্রকার মশলা ও ভেষজের  ঊষ্ণ মিশ্রণের কাথ।

মশলা চা-এ দুধ ও মিশ্রিত করা যায়।

মশলা চা পানের উপকারিতা :

এই চায়ে ব্যবহৃত সকল মশলাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন। শুধু গরমশলার ব্যবহার যেন এক কাপ চা পানের উপকারিতা বহুগুন বাড়িয়ে দেয়।

চায়ে মশলা ব্যবহারের ফলে এরা পরিপাকে সাহায্য করে। মৌসুমী সর্দি ও কাশি প্রতিরোধেও এই চা অত্যন্ত চমকপ্রদ কাজ দেয়।

মশলা চা বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন – পুদিনা চা, জাফরানি মালাই চা, আদা-লেবুর নোন্তা চা ইত্যাদি।

হার্বাল টী: মূলত দার্জিলিং চায়ের সাথে অর্জুন, পুদিনা, তুলসী, তেজপাতা, এলাচ, ব্রান্ভী মেশানো চা দারুন স্বাদ ও গন্ধ যুক্ত এবং হার্টের পক্ষে

ভীষণ উপকারী।

কবিরাজি চা : সাধারণত চায়ের সাথে বচ, পিপুল, মরিচ, লবঙ্গ, তেজপাতা, তালমিছরী সমন্বিত দুধ ও চিনি ছাড়া গ্রহণে গলাব্যাথা, সর্দিকাশিতে

দারুণ উপকারী।

গ্রীন টী এর প্রকার ভেদ এবং ব্যবহার :

সব ধরনের চা চা-গাছ বা ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থেকে তৈরী হয়।

অক্সিডেশনের যে মাত্রার মধ্য দিয়ে কাঁচা চা পাতা গুলি যায় সেখানেই পার্থক্য

সৃষ্টি হয়। আদর্শগত ভাবে ‘ব্ল্যাক টী’ হল সবচেয়ে বেশী অক্সিডাইজড এবং “গ্রীন টী’ হল আনঅক্সিডাইজড।

বিখ্যাত ‘ওলং টী’ হল আংশিক ভাবে অক্সিডাইজড এবং আরও কয়েক প্রকার চা আছে যে গুলি গাঁজানো কিন্তু সব সময় অক্সিডাইজড নয় (পুয়ের টী)।

অক্সিডেশন হল খাদ্য বস্তুর দ্বারা অক্সিজেনের শোষন যা খাদ্যবস্তুর জৈবরসায়ন বদল গুলি ঘটায়।

চা তৈরীর ক্ষেত্রে ঘরগুলির তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ করে, অক্সিডেশন আংশিক ভাবে প্রাকৃতিক এবং আংশিক ভাবে করা হয় নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়।

একবার চা-পাতা গুলি অক্সিডেশনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছে গেলে একটি বিশেষ গরম করার পদ্ধতি দ্বারা প্রক্রিয়াটি বন্ধ করা হয়।

হার্বাল টী চা-গাছের পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ যেমন হিবিসস্কাস (জবা), জেসমিন (জুঁই) ক্যামোমোমাইল থেকে প্রস্তুত করা হয়।

সুতরাং সেগুলি গ্রীন টী বলে গন্য হয় না। মিন্ট গ্রীন টী (পুদিনা), জেসমিন গ্রীন টী (জুঁই), লেমন গ্রীন টী ইত্যাদি বহু ধরনের ফ্লেভারে বাজারে গ্রীন টী পাওয়া যায়।

প্রোডাক্টের অকৃত্রিমতা সর্বদা লেবেল দেখে পরীক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। বিশেষ ধরনের চায়ের খোঁজ করলে, টী ব্যাগ, গ্রীন টী পাউডার, ক্যাপসুল বা ট্যাবলেটের আকারে বাজারে পাওয়া যায়।

ক্যাফিন বিহীন (ডিক্যাফিনেটেড) গ্রীন টা হল এক ধরনের গ্রীন টী যাকে ক্যাফিন অপসারনের অন্য পরিশ্রুত করা হয়েছে।

যারা ক্যাফিন সহ্য করতে পারেন না তাদের বিকল্প হিসাবে এটি বিবেচনা করা হয়।

এটা চায়ের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলির সংখ্যা কমিয়ে দেয়।

গ্রীন টী এর প্রকারভেদ :

সেন্চা গ্রীন টী : সেনচা (Sencha) হল জাপানী গ্রীন টী এর সবচেয়ে পরিচিত রূপ এবং সবচেয়ে সহজে তৈরী করা যায়। কাঁচা পাতা গুলিকে পরম্পরাগত রূপ দেওয়ার জন্য ভাপানো হয়, রোল করা হয় এবং অক্সিডেশন বন্ধ করার জন্য শুকানো হয়। তারপর পাতাগুলিকে এক কাপ জলের সঙ্গে ফোটানো হয় পান করার জন্য।

গিয়োকুরো গ্রীন টী : এই ভ্যারাইটির চা প্রক্রিয়াকরনের ক্ষেত্রে সেনচা থেকে আলাদা।

তোলার সময় অন্ততঃ ২০ দিন আগে থেকে গাছ গুলি একটি কাপড়ে ঢাকা হয়। এই পাতা গুলিতে ক্যাটেচিনের (স্বচ্ছ যৌগ) সংখ্যা কমাবার জন্য করা হয় যা চাকে বেশী স্বাদযুক্ত করে। আর এক ধরনের চা, কাবুসেচা (Kabusecha), একই ভাবে বড় হয় কিন্তু চা গাছ গুলিকে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য ঢাকা হয়।

মাচা গ্রীন টী : মাচা গ্রীন টী হল আর এক ধরনের পেষাই করা (গুঁড়ো) গ্রীন টী যা টেনচা (Tencha) নামে পরিচিত।

টেনচা গিয়েকুরো এর মতো ছায়ায় বড় হয়, কিন্তু এদের ঢেকে রাখার সময় ২০ দিনের চেয়ে বেশী হয়ে থাকে এবং রোলিং না করেই পাতা গুলি শুকানো হয়।

টেনচা টী জাহাজে চালান দেবার ঠিক আগে যখন এটা গুঁড়ো করা হয় তাকে মাচা (Matcha) বলা হয়।

চাইনীজ গ্রীন পাউডার টী: চাইনীজ গ্রীন টী তার নাম টি পেয়েছে এর পাতা গুলি প্রক্রিয়াকরণ এবং ভাপানোর পরে যে সুনির্দিষ্ট আকারে রোল এবং শুষ্ক করা হয় তা থেকে।

এটার একটা অদ্ভুত ধোঁয়াটে স্বাদ আছে যা এর এই নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে।

টী-ব্যাগ

টী-ব্যাগ আবিস্কারের গল্পও কম নয়।

টমাস সুল্লিভান নামে নিউইয়র্কের এক চা ব্যবসায়ী সিল্কের ছোট ব্যাগে ভরে নমুনা হিসাবে খদ্দেরদের কাছে পাঠাত।

তারা সেই ব্যাগ গরম জলে ডুবিয়ে চা করত। ১৯২০ সাল থেকে টী-ব্যাগ চালু হয়ে গেল। তাৎক্ষনিক চায়ের ব্যাপারটা গবেষণা লব্ধ।

এত সবের পরেও চায়ের সম্বন্ধেও আরও কত কিছু জানার আছে।

চীনের এক কবি লো তুং(অনুবাদ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)এর একটি কবিতা থেকে ৪টি লাইন তুলে দিয়ে আপনার আমার সবার মনের কথাটি বলা যাক,

‘প্রথম পেয়ালা কণ্ঠ ভেজায় দ্বিতীয় আমার জড়তা নাশে

তৃতীয় পেয়ালা মশগুল করে মজলিশ ক্রমে জমিয়া আসে।’

COPYRIGHT © SATKAHON

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *