সাতকাহন ‘আমার কলম‘ বিভাগে আপনার লেখা পাঠাতে চান?
WHATSAPP – 9038482776
MAIL– satkahonnews@gmail.com

১। যে কোন সাংস্কৃতিক বিষয় যেমন,
বাদ্যযন্ত্র, হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্র, হারিয়ে যাওয়া শিল্প, আপনার চোখে আপনার গুরু,
নৃত্যশৈলী, নাটক, বই, সাহিত্যিক, ইত্যাদি বিষয়ে অনধিক ৬০০ শব্দে লেখা পাঠাতে হবে।
২। লেখা হতে হবে বাংলায়।
৩। আপনার পরিচয় ও একটি ছবি অবশ্যই লেখার সাথে পাঠাতে হবে।

কালিকাপাতাড়ি | সায়ন দে | আমার কলম – Satkahon

কালিকাপাতাড়ি

কালিকাপাতাড়ি – হাওড়া জেলার নিজস্ব এক লৌকিক ঐতিহ্য
কলমে – সায়ন দে

গবেষক, হাওড়া জেলা ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র ও
কালিকাপাতাড়ি রিসার্চ এন্ড কালচার সেন্টার
পেশায় শিক্ষক, মেনকা স্মৃতি বিদ্যামন্দির

কালিকাপাতাড়ি | সায়ন দে

চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন, হাতের কাছে মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, কম্পিউটার, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেল, ইউটিউব, রিলস, টিকটক, ওটিটি – এসব কিচ্ছু নেই।

বিদ্যুৎ নেই, এসির আরাম নেই, এটিএম কিংবা ই-ওয়ালেটে টাকা নেই, নেই এক ক্লিকে মনপসন্দ খানা পিনা অর্ডার করার কোন সুবিধা।

কি ভাবছেন? আপনি অনেকটা কারাগারে কিংবা নির্জন কোন দ্বীপে নির্বাসিত?

কিন্তু ধরুন সেখানে আছে ক্ষেত ভরা ফসল, নির্মল জঙ্গলের হাওয়া, রাসায়নিক কীটনাশক বিহীন, কৃত্রিম রং বিহীন সুস্বাদু খাবারের সম্ভার।

মাস গেলে লোনের কিস্তি মেটাবার টেনশনের বদলে সেখানে ধরুন আছে কয়েকমাস হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর পর সেই ফসল দল বেঁধে ঘরে তোলার আনন্দ…

কালিকাপাতাড়ি

বিলাসবহুল পানশালায় বিদেশী সুরা ও সুরে ডুবে থাকা ভুলে ধরুন আছেন কলে কারখানায় কাজ সেরে ফিরে তালের রস খেয়ে উইক এন্ড-এ কোন চৈতি বাউলের আখড়ায়, কিংবা ভাঁড় যাত্রার আসরে?

ধরুন, আপনার গায়ে কেউ ট্যাটু করছে না, বরং খালি গায়ে একটু কাপড় জড়িয়ে কোন পল্লীবালা ঘরের নিকনো দোরে দিচ্ছে আল্পনা? – কি? অদ্ভুত মায়াময় একটা জগত মনে হচ্ছে কি?

যদি আপনার মনটাকে এই মায়ার জগতে নিয়ে যেতে পারেন তবেই আপনি বুঝতে পারবেন ‘কালিকাপাতাড়ি’ নামক হাওড়া জেলার এক নিজস্ব লৌকিক ঐতিহ্যকে।

তবেই আপনি অনুভব করতে পারবেন লোকনৃত্য ও লোকনাট্যের এক অদ্ভুত মিশেল হওয়া এই লোকরঞ্জনের (Folk entertainment) উপকরণকে।

কালিকাপাতাড়ি

শুধু হাওড়া জেলা নয়, গোটা ভারত তথা সমগ্র পৃথিবীতে প্রাচীন জনপদগুলোতে যুগ যুগ ধরে মানুষ পরিশ্রমের পর নিজেদের কষ্ট লাঘব করতে…

মনটাকে সতেজ করতে কোন জায়গায় সমবেত হতেন ও মনরঞ্জনের নানা মাধ্যম বেছে নিতেন।

অনেকটা আজকের পার্টি বা ফেস্টিভ্যাল-এর মতো আয়োজন হত, তবে সেখানে কোন বিদেশী সংস্কৃতিকে নকল করার খেলা থাকত না, সেখানে মিশে থাকত নিজস্ব মাটির রূপ, রস ও গন্ধ।

এটাকেই বলা যায় লোকরঞ্জন বা Folk entertainment।

একসঙ্গে মিলে মিশে থাকা ও প্রকৃতির মধ্যে থেকে উঠে আসা নিয়ম নীতি, আচার, আয়োজন – এসবই ছিল লোকধর্ম।

এখানে সবাই ছিল সমান। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ ভেদ ছিল, তবে তা এতো প্রকট ছিল না।

এই লোকধর্মের যেসব উৎসব আজও টিকে আছে আর মধ্যে অন্যতম হল চৈত্র মাসের গাজন উৎসব।

এই গাজন উৎসবের একটি অনুষঙ্গ হল কালিকাপাতাড়ি, যা হাওড়া জেলার লোকভাষায় উচ্চারিত হয় ‘কেলকেপাতাড়ি’ বা ‘কালকেপাতাড়ি’ হিসাবে।

 ‘কালিকা’, ‘কেলকে’ বা ‘কালকে’ আসলে দেবী কালী। আর ‘পাতাড়ি’ কথা এসেছে ‘পাতা’ শব্দ থেকে। ‘পাতা’ কথার অনেক অর্থ।

সাঁওতাল সংস্কৃতিতে আছে ‘পাতা নাচ’, সেখানে ‘পাতা’ মানে সারিবদ্ধ ভাবে নৃত্য।

বর্ধমানে গাজন উৎসবে কালীর মতো সেজে ‘বোলান গান’ এর সঙ্গে হাতে মড়া মানুষের খুলি নিয়ে একটি অদ্ভুত ‘শকুন নাচ’ হয়, যারা এই নাচ করেন তাদের বলা হয় ‘কালকেপাতা’।

এখানে ‘পাতা’ অর্থে পাত্র বা চরিত্র। কিন্তু হাওড়া জেলায় কালিকাপাতাড়ি নৃত্যের সঙ্গে ‘তালপাতা’-র একটা গভীর যোগ আছে।

কালিকাপাতাড়ি

গ্রামবাংলায় চৈত্রমাসে তালগাছের কচি নরম পাতা ও মোচা বের হয়। একে বলে ‘পাতাড়ি’।

এই তালপাতা ও মোচার খোলা দিয়ে তৈরি কারুশিল্পের সঙ্গেও ‘পাতাড়ি’ কথার যোগ আছে।

হাওড়া জেলায় কালিকাপাতাড়ি ঐতিহ্যে এটা কথিত আছে যে, যিনি কালিকা বা কালী সাজবেন তার সমস্ত আভরণ হবে তালপাতার তৈরি।

তালপাতার তৈরি ঘাগরা, তালপাতার অলঙ্কার, তালপাতার বিশাল মুকুট ইত্যাদি সে পরিধান করবে।

বর্তমানে এসব হয়না, তবে এখনো যে ধারাটি রয়ে গেছে তা হল একটি সিঁদুর রাঙানো তালপাতার তৈরি নকল জিভ দাঁতে কামড়ে ধরে থাকেন এরা।

তালের রস বা তাড়ির সঙ্গেও এর সম্পর্ক ওতপ্রোত। তাল গাছের ‘পাতা’ ব্যবহার হয় বলেই হয়ত এই নাচের নামকরণ ‘কালিকাপাতাড়ি’।  

কালিকাপাতাড়ি

চৈত্রমাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে বাংলার গ্রামেগঞ্জে চলে প্রাচীন লোকউৎসব ‘গাজন’।

একদম সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে শত শত বছর ধরে চলছে এই উৎসব, মেলা, লৌকিক দেবদেবীদের পূজার্চনা ও মানুষে মানুষে সম্মিলনের প্রথা।

হাওড়া জেলাও এই লৌকিক ঐতিহ্য থেকে আলাদা নয়।

প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই চৈত্র মাসের শেষ কয়েকদিন চলে গাজন উৎসব…

যেখানে একদম নরনারী ‘ভক্ত সন্ন্যাসী’ সেজে গলায় উতরীয় ও পরনে নতুন ধুতি, শাড়ী ও গামছা নিয়ে একটি বাঁশের মাথায় ধ্বজা লাগিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নানা রকম উপাচার পালন করেন।

শেষ তিনদিন সৃষ্টির আধার হিসাবে সূর্যদেবতা ও যনিস্তম্ভ আরাধনা করে চলে ‘অর্গি’ নাচ, রাতে ধর্মঠাকুর, শিবঠাকুর, বিশালাক্ষী, পঞ্চানন্দ, শীতলা, মনসা, দক্ষিণরায়, ক্ষেত্রপাল সহ প্রায় প্রত্যেক গ্রামীণ লৌকিক দেবদেবীর থান বা মন্দিরের সামনে হয় বঁটির ওপর রূপক ঝাঁপ পড়া, বানফোঁড়া, কাঁটাগোড়েন, ‘খাটাখাটুনি’ বা দৈহিক কসরত সহ নানান কার্যকলাপ।

২৯ চৈত্র নীলরাত্রি হিসাবে পালিত হয় নীল বা শিবের সঙ্গে নীলাবতী বা পার্বতীর বিবাহ উৎসব এবং চৈত্র সংক্রান্তির দিন থাকে শিবের ঝাঁপ ও সেবা।

অনেকে বলেন – লৌকিক ‘শিব’-এর বিবাহ বা নীল পুজো উপলক্ষ্যেই এই সময় তিনদিনের উৎসব ‘গাজন’ এর  সৃষ্টি হয়েছিল।

আর এই নীলরাত্রির নীলপুজো বা নীলষষ্ঠীর ব্রত পালনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ‘সঙ’ সাজা।

কখনো শিব, দুর্গা, নানা রকমের ভূত-প্রেত, কখনো কালী – এমন বহুরূপী সাজে মানুষজন বেরিয়ে পড়ত এই উৎসব পালনের আমোদে।

চলত রাতভোর হই হুল্লোড়, গান ও নাচ। এর মধ্যে দিয়েই মানুষ নিজেদের মনোরঞ্জনের উপায় খুঁজে নিত।

satkahon

এই প্রেক্ষিতেই বাংলার নানা প্রান্তে নানা রকমের গাজন নাচ, সঙের নাচ, ভূতের নাচ, কালীর নাচের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রত্যেক এলাকার নিজস্ব নিজস্ব ঘরানা, নিজস্ব নিজস্ব শৈলীর জন্ম হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

হাওড়া জেলাতে এই নীলরাত্রির নীল-নীলাবতীর বিয়েকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত কালী ও শিব সেজে মশাল জ্বেলে হাত পা ছুঁড়ে বিশেষ এক ধরণের উদ্দাম নাচই পরিচিত হয়েছে কালিকাপাতাড়ি নাচ হিসাবে।

এই শৈলী হাওড়া জেলা ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

এখানে কালিকাপাতাড়ি শিল্পীরা সাধারণত কালো ব্লাউজ ও কালো ল্যাঙট পরার পর গোটা গায়ে ভুষো কালি (গ্রামের ঘরে ঘরে ব্যবহৃত ধান সিদ্ধ করার হাঁড়ির তলা থেকেই এই ভুষো কালি সংগ্রহ করা হত) মেখে নেন, আর থাকে প্রয়োজনমত তেলে গোলা লাল টকটকে সিঁদুর।

মাথায় থাকে দীর্ঘ ঘন কালো শনের পরচুল। তালপাতার জিভ তো থাকেই, সেই সঙ্গে হাতে থাকে খড়গ। গলায় জবা ফুলের মালা ও অন্যান্য সাজ।

শিবের পোশাক হল  এই নাচের তাল হাওড়া জেলার এক এক জায়গায় এক এক রকম। সেই তাল নির্ধারিত হত ঢাক ও ঢোল বাদকদের সঙ্গে এক অদ্ভুত বোঝাপড়ায়।

কালী যিনি সাজেন তিনি ছুটে যান এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায় এবং নাচের সময় এক অদ্ভুত ঘোরে বা মোহের মধ্যে থাকেন।

লোকে বলেন নাচের সময় দেবতা বা অপদেবতা এসে ওই শিল্পীর ওপর ভর করেছেন।

এই নাচ অনেকটা বীররসের নাচ।

তাই তাদের এলোপাথাড়ি নৃত্যে অনেক সময় অনেক দর্শক আহতও হয়ে যান।

satkahon

হাওড়া জেলার মূলত দক্ষিণ ভাগে, অর্থাৎ উলুবেড়িয়া, বাগনান ও শ্যামপুর থানা এলাকার বহুগ্রামেই এই কালিকাপাতাড়ি নৃত্যের চল ছিল।

এখন কমে গিয়ে উলুবেড়িয়ার কালীনগর, বলরামপুর, শ্যামপুরের রতনপুর, কোটরা সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে এবং বাগনানের বাইনান, বাঙালপুর, ভুয়েঁড়া, হারপ, চাকুর প্রভৃতি গ্রামে গাজনের সময় নীলরাত্রিতে এই লোকনৃত্য আদি রূপে দেখতে পাওয়া যায়।

তবে ১৯৯০-এর দশকে শ্যামপুরের রতনপুর গ্রামের জলধর বাগ ও শ্যামপুর গ্রামের বলরাম দাস-এর নেতৃত্বে এই লোকনৃত্য অনেকটা যাত্রার মতো পালা হিসাবে জনপ্রিয় হয়।

সরকারী স্বীকৃতি জোটে।

বর্তমানে এই দুটি দল সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের তরফে দেশে বিদেশে হাওড়া জেলার লোকনাট্য হিসাবে কালিকাপাতাড়িকে তুলে ধরার কাজ করছে।

satkahon

২০২২ সালে হাওড়া জেলার আমতা থানার উদং গ্রামে লোকসংস্কৃতি গবেষক প্রদীপ রঞ্জন রীত মহাশয়ের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ‘কালিকাপাতাড়ি রিসার্চ এন্ড কালচারাল সেন্টার’।

ধীরে ধীরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ও আঞ্চলিক ইতিহাস আলোচনায় জায়গা করে নিচ্ছে এই ঐতিহ্য।

কৃষিনির্ভর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে বাংলা বছরের শেষ কয়েক দিনের এই উৎসবের আগ্রহ, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, বিশ্বাস, ভক্তি ও মনোরঞ্জন – এখনো দেখার মতো।

ইন্টারনেট, মোবাইল, ডিজিটাল দুনিয়ার মোহ নতুন প্রজন্মকে দ্রুত এসব শিকড়ের টান থেকে ছিন্ন করে দিতে চাইলেও বাংলার মাটির অন্তর থেকে উঠে আসা এই লোকসংস্কৃতি সহজে হয়তো মুছে যাবার নয়।

তথ্য সহায়তা

১। লোকায়ত হাওড়া – তপন কর (পুস্তক বিপণী, কলকাতা, ২০১৫)
২। হাওড়া জেলার লোকসংস্কৃতির সন্ধানে – তপনকুমার সেন (সাহিত্যশ্রী, কলকাতা, ২০২১)
৩। হাওড়া জেলার লোকসংস্কৃতি – শিবেন্দু মান্না (অক্ষর প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৮)
৪। শ্যামপুরের ইতিবৃত্ত – সত্যব্রত দাস (অরুণোদয় সাহিত্য পরিষদ, শ্যামপুর, ২০২২)

COPYRIGHT © 2020 SATKAHON

4 thoughts on “কালিকাপাতাড়ি | সায়ন দে | আমার কলম – Satkahon”

  1. Debasish Senapati

    Nice work I remember in my childhood some song are Sang by the “sannyasi” if possible please collect and archive thank you

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *